নাহিদ মিথুনঃ জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০০৩ সালের ৩১ অক্টোবর ‘আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সনদ’ অনুমোদিত হয়। একই বছর ৯ থেকে ১১ ডিসেম্বর মেক্সিকোয় উচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ের স্বাক্ষরের উদ্দেশ্যে সনদটি উম্মুক্ত করা হয়।এরপর প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮ তে দেশের উন্নয়নে বিভিন্ন বিষয়ে অঙ্গীকার করেছিল আওয়ামী লীগ।
গ্রামভিত্তিক উন্নয়ন তথা গ্রামে আধুনিক সুবিধার উপস্থিতি, শিল্প উন্নয়ন, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, জলবায়ু পরিবর্তন ও সুরক্ষা, মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণসহ বিভিন্ন খাতে পরবর্তি ৫ বছরের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছিলো ইশতেহারে। ১৮ই ডিসেম্বর ২০১৮ মঙ্গলবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির সামনে দলের নির্বাচনী ইশতেহার তুলে ধরেন। বিভিন্ন বিষয়ের সাথে উক্ত ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধেও জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয় এবং বলা হয়ঃ দুর্নীতি একটি বহুমাত্রিক ব্যাধি। পেশিশক্তির ব্যবহার ও অপরাধের শিকড় হচ্ছে দুর্নীতি। যার ফলে রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে অবক্ষয় বা পচন শুরু হয় এবং অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন প্রভৃতি কোনো ক্ষেত্রেই ইস্পিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না। দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও আইনের প্রয়োগ মুখ্য হলেও তা শুধু সরকারের দায় নয়, জনগণেরও দায় রয়েছে। আমরা মনেকরি দুর্নীতি দমনে প্রয়োজন সরকার ও জনগণের সমন্বিত পদক্ষেপ।
লক্ষ্য ও পরিকল্পনা:
• দুর্নীতি দমন কমিশনকে কর্ম পরিবেশ ও দক্ষতার দিক থেকে যুগোপযোগী করে আধুনিকায়ন করা হবে। সেক্ষেত্রে দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় এবং প্রায়োগিক ব্যবহারে সহযোগিতা করবে সরকার।
• বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ ও তদারকি ভবিষ্যতে আরো জোরদার করা হবে।
• দুর্নীতি প্রতিরোধে আইনী ব্যবস্থার পাশাপাশি রাজনৈতিক, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ জোরদার করা হবে।
• ঘুষ, অনোপার্জিত আয়, কালো টাকা, চাঁদাবাজি, ঋণখেলাপি, টেন্ডারবাজি ও পেশীশক্তি প্রতিরোধ এবং দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
৩০ ডিসেম্বর ২০১৮তে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ। ৭ জানুয়ারি নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৭ জানুয়ারি তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অফিস করেন।
সেখানে কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ক্ষুধা এবং দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সুশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যা প্রয়োজন সেটা তো আমরাই মেটাচ্ছি। তাহলে দুর্নীতি কেন হবে? কেউ দুর্নীতি করলে সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।’
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ভিত্তিতে কর্মপরিকল্পনা তৈরি শুরু হয় প্রশাসনে। দুর্নীতিমুক্ত ও জনবান্ধব প্রশাসন গড়তে এ পদক্ষেপ নেয়া হয় ।
অতীতে নির্বাচনী ইশতেহার ধরে কেউ কর্মপরিকল্পনা করেছে বলে জানা নেই- মন্তব্য করেছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রশাসনবিষয়ক কলামিস্ট আলী ইমাম মজুমদার। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে এ ধরনের কথা না বললেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান সব সময়ই ছিল। দুর্নীতি কেউ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আইন ছিল, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ছিল, উদ্যোগও ছিল। এবার এটাকে জোর দেয়া হচ্ছে ইশতেহারে আসছে বলে। এটা ভালো একটি উদ্যোগ। আমি মনে করি, এটি বাস্তবায়ন হলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান আরও জোরদার হবে। পাশাপাশি প্রশাসনে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। তবে এ কর্মপরিকল্পনা কাগজে-কলমে থাকলে দেশ-জাতির কোনো উপকার হবে না।
১২ জুন, ২০১৯ বুধবারে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে বেগম রওশন আরা মান্নানের তারকা চিহ্নিত প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেনঃ বর্তমান সরকার টানা তৃতীয়বার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশের জনগণের কল্যাণে এবং দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে এ সময় ভোক্তা অধিকার রক্ষায় ম্যাজিস্ট্রেট মনজুর শাহরিয়ারকে স্বপদে থেকে অভিযান চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন তিনি।তিনি বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) শক্তিশালী করা, জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার এবং আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার বিশেষ পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। এর মাধ্যমে সরকার দুর্নীতির বিষবৃক্ষ সম্পূর্ণ উপড়ে ফেলে দেশের প্রকৃত আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জনকল্যাণে একটি সুশাসনভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠন করতে বদ্ধপরিকর। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে দুদক এনফোর্সমেন্ট টিমের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ও সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/দফতরে তাৎক্ষণিক অভিযান পরিচালনা করছে। ফলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা কমে আসছে।
১লা জানুয়ারি ২০২০বুধবার বেলা ১১টায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে দুর্নীতি দমনে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা শীর্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন মাটি খুঁড়ে শিকড় বের করতে হবে। মাটির নিচে অনেক শিকড় থাকে, সেখান থেকে মূল শিকড় বের করতে দরকার সঠিক অনুসন্ধান। আর সেটি করবে সাংবাদিকরা। সাংবাদিকরাই আমাদের প্রাথমিক তথ্যের উৎস। আমাদের নিজেদের তথ্যভাণ্ডার খুব সীমিত।
অপরাধবিষয়ক তথ্য পাওয়া সম্পর্কে দুদক চেয়ারম্যান আরও বলেন, সাংবাদিকদের পরেই আমাদের সব থেকে বড় তথ্যের উৎস হলো হটলাইন নম্বর ১০৬। এ হটলাইন নম্বরটি যেন বেশি প্রচার পায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে সাংবাদিকদের আহ্বান জানান তিনি।
২৫ অক্টোবর ২০২০ রবিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠান উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন আপনাদের রিপোর্ট পড়েই আমরা অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াই, অন্যায়ের প্রতিকার করি, দোষীদের শাস্তিও দেই।
৮ই ডিসেম্বর ২০২০ মঙ্গলবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল- টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বিবৃতিতে বলেন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহনশীলতার’ ঘোষণা থাকলেও এখনকার বাস্তবতায় তা কী অর্থ বহন করে, তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারেন না বলে মন্তব্য করেন তিনি। “আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই ঘোষণার বাস্তবায়ন আটকে যাচ্ছে শুধু চুনোপুঁটিদের টানাটানিতে।
সাংবাদিক সমাজে “হলুদ সাংবাদিক” বলে একটা শব্দ প্রচলিত আছে। দেখা যায় অনেক অপরাধী সাংবাদিক পরিচয় নিচ্ছে, হলুদ সাংবাদিকেরা অপরাধীদের আশ্রয়, প্রশ্রয় ও রক্ষা করছে। ভাল সাংবাদিকেরা কোণঠাসা হয়ে পরছেন; সংবাদ প্রকাশে ভয় পাচ্ছেন। ফলশ্রুতিতে হলুদের শক্তি ও সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাষ্ট্র তথ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দুর্নীতি দমনের গতি বাধাগ্রস্ত হবে, জনসাধারন ব্যথিত হবেন আর তারা না বুঝে যার দোষ নয় তাকে দোষারপ করবেন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ন স্তম্ভ সংবাদ মাধ্যম আর এই স্তম্ভকে সুস্থ ও শক্তিশালী রাখা জরুরী ; কেউই আইনের উর্ধে নয়, সাংবাদিকরাও নন। ঘুষের বিনিময়েই হলুদেরা অপরাধ করে, বড় বড় অপরাধীকে রক্ষা করে। এরা পতিতা ও ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বানায় সমাজ সেবক ও নেতা আর দরিদ্র নির্যাতিতকে বানায় অপরাধী। রাষ্ট্রের কোনও সংস্থা অভিযান পরিচালনা করে কোনও অপরাধীকে ধরলে কেবল তখনই এই হলুদ সাংবাদিকেরা তার সাংবাদিক পরিচয় ধরে রাখতে কদাচিৎ দুই একটা চুনোপুঁটিদের সংবাদ প্রচার করার উদ্যোগ নেয়; যদি অপরাধীর তরফ থেকে কিছু অর্থ বা আশ্বাস পায় তবে সেই সংবাদটিও প্রকাশে বিরত থাকে।
তাই সাংবাদিকদের সার্বিক কার্যক্রম মনিটরিং করার জন্য ” দুর্নীতি দমন কমিশন”-এ একটি বিশেষ ব্রাঞ্চ খোলা যেতে পারে। যে ব্রাঞ্চটি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, জনসাধারন ও সাদা সাংবাদিকদের সাথে সমন্নয় করে কাজ করবে। তদন্ত সাপেক্ষে নির্দিষ্ট সময় পরপর হলুদ রঙের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিবে এবং সেই তথ্য জনসাধারনের কাছে প্রকাশ করবে। এতে আশা করা যায় ভাল সাংবাদিকেরা রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করতে পারবেন, রাষ্ট্র শক্তিশালী ইন্দ্রিয় পাবে ও তার পথ চলা গতি পাবে।
————–
নাহিদ মিথুন
লেখক ও সাংবাদিক
তথ্য ও গবেষনা সচিবঃ জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা
ইমেইলঃ samataldesk@gmail.com