মঙ্গলবারের সেই সন্ধ্যাটি ছিল আর যেকোনো দিনের মতোই। এক পাকিস্তানি সেনা অফিসারের স্ত্রী কমাল সেদিন বাড়িতে রাতের খাবার তৈরির জন্য সবজি কাটছিলেন। তার দুই কন্যা টেলিভিশন দেখছিল। কমালের স্বামী তখন কাজ করছেন একটি সংঘাতপূর্ণ এলাকায়।
কমাল যে সামরিক কম্পাউন্ডের মধ্যে থাকেন, সেটি সম্ভবত পাকিস্তানের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাগুলোর একটি। কিন্তু এই এলাকাটির মধ্যেও তারা শিগগিরই অনিরাপদ বোধ করতে শুরু করলেন।
সেদিন কমালের স্বামী যখন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশ আগে ফোন করলেন, তখন তিনি বেশ অবাক হলেন।
স্বামী তাকে দরজা বন্ধ রাখতে বললেন, কারণ দেশজুড়ে সামরিক এলাকাগুলোতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সমর্থকরা আক্রমণ চালাতে শুরু করেছেন। লাহোরে একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেলের বাসভবনে এরই মধ্যে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে।
‘এরা যদি এরকম নগ্নভাবে একজন জেনারেলের বাড়িতে হামলা চালাতে পারে, তাহলে এরপর কি আমাদের ওপর হামলা হবে? এই চিন্তা মাথায় আসার পর আমি তো ভয়ে কাঁপছিলাম,’ বলছিলেন কমাল। এটি তার ছদ্মনাম। নিজের নাম তিনি প্রকাশ করতে চাইছেন না।
কমাল সাথে সাথে তার বাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ করে দিলেন। লুকিয়ে থাকতে হতে পারে এমন আশংকায় খাবার-দাবার নিয়ে রাখলেন স্টোর রুমে।
এমনকি বাড়িতে যদি আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়, তখন কোন পথে তিনি তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে পালাবেন- সেটাও ভাবতে লাগলেন। দুই মেয়েকে নিয়ে তিনি কি জানালা দিয়ে লাফ দিতে পারবেন?
কমাল বলেন, ‘আমি যখন এই প্রতিবাদের ভিডিও দেখছিলাম, এটি আমাকে রীতিমত আতঙ্কিত করে তুলেছিল। জীবনে কখনো নিজেকে এতটা নিরাপত্তাহীন মনে হয়নি।’
তবে একইসাথে কমালের মন ছিল ক্ষত-বিক্ষত। কারণ তিনি ইমরান খানের একজন কট্টর সমর্থক।
‘আমি এবং আরো অনেকে আসলে ইমরান খানকে সমর্থন করেছি একটা পরিবর্তনের আশায়। কিন্তু যার জন্য আমি এত সোচ্চার ছিলাম, মনে হলো তিনি যেন আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তিনি যেরকম দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে কথাবার্তা বলেছেন, তা ঘৃণা এবং সহিংসতায় উস্কানি দিয়েছে, যা কিনা পুরো দেশ কাঁপিয়ে দিয়েছে,’ বলছিলেন তিনি।
বদ্ধমূল ধারণা
দেশজুড়ে এই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর জন্য এক অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল।
পাকিস্তানে বহু দশক ধরে সরাসরি সামরিক শাসন চলেছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর অন্তত তিনবার সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে।
যদিও ২০০৮ সালে সরাসরি সেনাশাসনের অবসান ঘটেছে আনুষ্ঠানিকভাবে, তবে অনেকের বিশ্বাস পাকিস্তানে রাজনীতিকদের পেছনে থেকে এখনো কলকাঠি নাড়ে সামরিক বাহিনীই। ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ আসলে তাদেরই হাতে। ইমরান খান আসলে তাদেরই আশীর্বাদপুষ্ট- এটাও মনে করা হয়।
এমনকি পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টি (পিটিআই) ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসার আগে ইমরান খানের পরিচিতি ছিল পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ‘ডার্লিং’ বা প্রিয়ভাজন বলে।
তার সমালোচকরা বলে থাকেন, সেনাবাহিনীর সোশ্যাল মিডিয়া টিম ইমরান খানকে পাকিস্তানের ‘ত্রাণকর্তা’রূপে চিত্রিত করে, যিনি কিনা পাকিস্তানে বংশানুক্রমিক রাজনীতি এবং দুর্নীতিগ্রস্ত এলিটদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারেন।
কিন্তু যখন পাকিস্তানের ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনীর সাথে ইমরান খানের সম্পর্ক ভেঙে গেল, গত বছর তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তবে তা সত্ত্বেও সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরে অনেকের মধ্যেই ইমরান খানের ব্যাপারে এরকম একটি ধারণা বিরাজমান ছিল।
সেনাবাহিনীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নারী চিকিৎসা কর্মকর্তা গুল নিজেকে একজন অরাজনৈতিক মানুষ বলেই ভাবেন। কিন্তু এখন তিনি ইমরান খানের সমর্থকদের ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ।
যেদিন রাতে দাঙ্গা হলো, সেদিন তিনি পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য বাড়ির বাইরে ছিলেন। তার বাবা-মা বাড়িতে তার সন্তানদের দেখাশোনা করছিলেন।
‘আমার মনে হচ্ছিল আমি যদি ওদের সাথে থাকতে পারতাম। আমার মনে হচ্ছিল, যদি ওদের ওপর কোনো হামলা হয়, কেউ যদি আহত হয়, বা মারা যায়, তখন কী হবে? আমার মনের মধ্যে তখন কী যে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। ওইদিন যে কি ভীষণ খারাপ সময় গেছে, বিশেষ করে ওই মুহূর্তে একজন মা হিসেবে আমি যখন আমার সন্তানদের কাছ থেকে দূরে, তখন কেমন যে লাগছিল তা বলে বোঝাতে পারব না।’
কিন্তু এতকিছুর পরও সেনাবাহিনীর ভেতরে অনেকে এখনো ইমরান খানকে সমর্থন করেন। তিনি কেবল সাধারণ মানুষের মধ্যে নন, সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন স্তরের সদস্যদের মধ্যেও এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিক।
‘যদি এখনকার রাজনীতিকদের মধ্যে থেকে কাউকে বেছে নিতে হয়, তাহলে আমি ইমরান খান ছাড়া আর কাউকে ভোট দেব না,’ বলছিলেন একজন সেনা কর্মকর্তা, যিনি তার নাম-পরিচয় গোপন রাখতে চান।
আরেকজন সেনা কর্মকর্তাও বললেন একই কথা, তিনি এখনো এই সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন করেন।
‘লাহোরে একজন জেনারেলের বাসভবনে যা ঘটেছে, তার জন্য আমি আসলেই দুঃখিত। আমরা জানি না কারা এই কাজ করেছে। ইমরান খান বলেছেন তার দলের লোকজন এটা করেনি। কিন্তু এসব কোনো কিছুতেই ইমরান খানের প্রতি আমার সমর্থন বদলায়নি। একজন ভোটার হিসেবে এখনো আমার সমর্থন তার দিকে, এবং আমি তাকে সমর্থন করেই যাব। আমার কাছে তিনি একজন অনুপ্রেরণাময় সত্যিকারের নেতা,’ বলেন তিনি।
একটি নিরাপত্তা সংস্থার ঊর্ধ্বতন পদে কাজ করেন এমন একজন কর্মকর্তা বলছিলেন, তার অধীনস্থ কর্মকর্তারাও মাঝে-মধ্যে প্রশ্ন তোলেন পাকিস্তান যেভাবে চলছে, সেখানে সামরিক বাহিনী কী ভূমিকা পালন করে তা নিয়ে।
ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব আলোচনা চলে, এদের রাজনৈতিক মতামত সেসব দ্বারা প্রভাবিত।
‘এরা নিরেট প্রমাণ চায় যে সামরিক বাহিনী রাজনীতিতে নাক গলায় না। তারা এর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং আমাদের তখন তাদের পরিষ্কার করে বোঝানোর মতো জবাব দিতে হয়,’ বলছিলেন তিনি।
অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তারাও ইমরান খানকে জোরালোভাবে সমর্থন করেন।
সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি তৈরিতে তাদের বেশ ভালো প্রভাব আছে। ১৫ বছর আগে অবসরে যাওয়া সামরিক অফিসার রাজা শাহরিয়ার বলেন, ২০১৮ সালে তিনি ইমরান খানকে ভোট দেন, সেবারই প্রথম তিনি কোনো নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন।
‘আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি। তবে গত কিছুদিনের ঘটনাবলীতে আমি ক্ষুব্ধ। কারণ পিটিআইর নেতৃত্ব তাদের কর্মী-বাহিনীকে নিবৃত্ত করতে পারেনি যখন তারা সরকারি স্থাপনা ও সম্পত্তিতে হামলা চালাচ্ছিল। তাদের উচিৎ ছিল অন্যদের চেয়ে ভালো আচরণ করা।’
এই হামলার পর সেনাবাহিনী এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে নিজেদের অবস্থান নেয়। সামরিক বাহিনীর একজন মুখপাত্র পাকিস্তানি টেলিভিশন চ্যানেল জিও টিভিতে বলেন, সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধান গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন।
তিনি আরো বলেন, ‘দেশের ভেতরে-বাইরের চরমপন্থী ও শত্রুদের অপপ্রচার সত্ত্বেও সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ।’
সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অসন্তোষ
কিন্তু পাকিস্তান এখন বিভক্ত। রাজা শাহরিয়ার বলেন, তিনি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে এত মারাত্মক অসন্তোষ এবং একে ঘিরে এরকম তীব্র রাজনৈতিক মেরুকরণ পাকিস্তানে আর দেখেননি।
তবে অনেক সামরিক পরিবার মনে করে, সেনানিবাসে আক্রমণের চালিয়ে একটা সীমা অতিক্রম করা হয়েছে। অন্যদিকে পিটিআইর সমর্থকরা মনে করে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে বাড়াবাড়ি করা হয়েছে।
গত ৯ মে’র বিক্ষোভের সময় ১০ জনের বেশি বিক্ষোভকারী নিহত হয়।
তারিক নাসির সেদিন এক ঘণ্টা ধরে তার ভাই ওমরকে খুঁজেছেন কোয়েটার একটি সরকারি হাসপাতালে। ২৬ বছর বয়সী ওমর সেদিন শহরের সেনানিবাসের বাইরে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন, তখন তিনি সেখানে নিহত হন।
‘সেখানে অনেক টিয়ার গ্যাস ছোড়া হচ্ছিল। ওমর তার হাতে লবণ আর পানি রেখেছিল কাঁদানে গ্যাসের শিকার মানুষদের সাহায্য করতে। ও ছিল নিরস্ত্র, শান্তিপূর্ণ। এরকম বিক্ষোভে অংশ নেয়ার অধিকার আছে ওর, সেটাই ও করছিল। ওরা সোজা ওর মাথায় গুলি করেছে। ও যেখানে নিরস্ত্র, কেন ওর ওপর গুলি চালানো হলো,’ প্রশ্ন করলেন তিনি।
ইমরান খান দাবি করেন, সেদিন যারা পুলিশের ওপর পাথর ছুড়েছে বা সেনানিবাসে হামলা করেছে তারা পিটিআইর সমর্থক ছিল না।
একই দাবি করলেন তারিক নাসির। তিনি সন্দেহ করেন, এখানে একটা ষড়যন্ত্র ছিল।
সেনাবাহিনী এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে যারা সেনা স্থাপনার ওপর হামলায় জড়িত ছিল তাদের সামরিক আদালতে এবং সন্ত্রাসবাদবিরোধী আদালতে বিচার করা হবে।
এই তাণ্ডবের জন্য মানুষের ক্ষমা চাওয়ার অনেক ভিডিও এখন পুলিশ প্রচার করছে। বলা হচ্ছে, পিটিআইর নেতৃত্বের অনুরোধে এরা ক্ষমা চেয়েছে। তবে অনেকের অভিযোগ, পুলিশ তাদেরকে জোর-জবরদস্তি করে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছে।
ইমরান খান বলেছেন, যারা সেনা স্থাপনায় হামলা করেছে তারা তার দলের কেউ নন। তিনি পুরো ঘটনা তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
তবে ইমরান খানের দলের অনেক নেতা এবং তার ঘনিষ্ঠ অনেক সহযোগী এর মধ্যে তাকে ত্যাগ করেছেন, তারা একজন জেনারেলের বাড়িতে হামলা এবং সেনা-স্থাপনায় হামলার নিন্দা করেছেন। এদের অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছিল, পরে অবশ্য তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।
তারিক নাসির বলেন, ‘আমার ভাই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অংশ নিতে গিয়ে নিহত হয়েছে। যখন ও মারা যায়, তখন ওর গলায় পেঁচানো ছিল ইমরান খানের দলের পতাকা। ও ইমরান খানের জন্য মারা গেছে। ও একটা ভালো পাকিস্তান চেয়েছিল, ইমরান খান ছিল তার কাছে আশার আলো। একদিন ওর স্বপ্ন পূরণ হবে। তখনই হয়তো আমরা ন্যায়বিচার পাবো।’
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের অভিযোগ অনেক পুরনো। বলা হয়, তারাই সেখানে সরকারকে ক্ষমতায় বসায়, ক্ষমতা থেকে সরায়।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলগুলোর বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে সহিংস পথে বিরোধী দলকে দমন করার।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যেও সেনাবাহিনী ও রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়ছে।
‘ওদের মতো আমিও তো ইউনিফর্ম পরি। আমি ওদের সব জানি। ওরা মনে করে ওরা আইনের ঊর্ধ্বে। একমাত্র ইমরান খানই এদের ঠিক করতে পারবে,’ বলেন একজন পুলিশ অফিসার।
‘এই রাজনীতিকদের কাছ থেকে আমরা কী আশা করি? সংসার চালানোর মতো একটা বেতন, যাতে আমরা মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারি। এটা কি খুব বেশি কিছু?’
‘ওরা আমাদের এই চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। সামরিক বাহিনী বলুন, বা রাজনীতিক, এরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করতে ব্যস্ত, আর দেশটা রসাতলে যাচ্ছে।’
সূত্র : বিবিসি