ভারতে থাকতে হলে মুসলিমদের ‘শ্রেষ্ঠত্ববাদী’ মানসিকতা বিসর্জন দিয়েই থাকতে হবে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবতের এ ধরনের একটি মন্তব্যে দেশ জুড়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছে।
আরএসএসকে দেশের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির আদর্শিক অভিভাবক বলে গণ্য করা হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির কথা সুবিদিত।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেও আরএসএসের প্রচারক ছিলেন। ফলে ওই সংগঠনের প্রধান ভারতে মুসলিমদের থাকার বিষয়ে মন্তব্য করায় বিস্তর বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দল মোহন ভাগবতের এ মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছে।
হায়দারাবাদের এমপি আসাদউদ্দিন ওয়াইসি তো এমনও বলেছেন, ‘ভারতে মুসলিমদের থাকার বিষয়ে অনুমতি দেয়ার বিষয়ে আরএসএস কে?’
দেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে আবার মোহন ভাগবতের এ মন্তব্যে ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবারের উগ্র হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডায় ফিরে যাওয়ার সঙ্কেত দেখতে পাচ্ছেন।
আরএসএস সরসঙ্ঘচালকের এই বক্তব্যকে ঘিরে বিতর্ক শুরু হওয়ার পর সংগঠনের পক্ষ থেকেও আত্মপক্ষ সমর্থনে এগিয়ে আসা হয়েছে।
খবরের কাগজে কলাম লিখে আরএসএস নেতারা দাবি করছেন, সংবাদমাধ্যম মোহন ভাগবতের বক্তব্যকে ভুল বুঝেছে। সেখানে তার কথাকে ‘আউট অব কনটেক্সট’ বা প্রসঙ্গবহির্ভূতভাবে তুলে ধরা হচ্ছে।
তবে ভারতীয় মুসলিমদের নিয়ে আরএসএস প্রধান যে আবার একটি তীব্র বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
ঠিক কী বলেছেন ভাগবত?
আরএসএস প্রধানের যে বক্তব্যকে ঘিরে এত হইচই, সেটি তিনি দিয়েছেন সংগঠনের হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার মুখপত্র, যথাক্রমে ‘পাঞ্চজন্য’ ও ‘দ্য অর্গানাইজার’-কে এক সাথে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে। ওই পত্রিকা দু’টিতে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় গত ১০ জানুয়ারি।
সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সরল সত্যটা হল, হিন্দুস্থানকে হিন্দুস্থানই থাকতে হবে। তবে ভারতে মুসলিমরা যদি বসবাস করেন, তাতে কোনো ক্ষতি নেই।’
‘মুসলিমরা যদি নিজেদের ধর্মবিশ্বাস আঁকড়ে থাকতে চান, তারা তা পারেন। আবার যদি তারা চান, নিজেদের পূর্বপুরুষের ধর্মবিশ্বাসে ফিরে আসবেন, তাদের জন্য ওই রাস্তাও খোলা আছে। এটা পুরোপুরি তাদের ব্যাপার।’
তিনি আরো বলেন, ‘হিন্দুদের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো একগুঁয়েমি নেই। (ভারতে) ইসলামেরও ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’
‘তবে মুসলিমদের মধ্যে যে ‘সুপ্রিমেসি’ বা শ্রেষ্ঠত্ববাদের উচ্চকিত রেটোরিক আছে, সেটাও তাদের ত্যাগ করতে হবে।’
ভারতে হিন্দু ও মুসলিম সমাজের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে তিনি আরো বলেন, গত হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতের হিন্দুরা বিদেশী আগ্রাসন, প্রভাব ও বিদেশী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। এই নিরন্তর যুদ্ধ করে যাওয়ার ফলে তাদের আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠাটা খুবই স্বাভাবিক।
ভারতীয় সমাজে এলজিবিটিকিউ বা সমকামী-ট্রান্সজেন্ডারদের সসম্মানে থাকার অধিকারের পক্ষেও ওই সাক্ষাৎকারে মুখ খুলেছেন মোহন ভাগবত। তবে সবচেয়ে বেশি চর্চা হচ্ছে হিন্দু-মুসলিম সঙ্ঘাত প্রসঙ্গের বক্তব্য নিয়েই।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস মোহন ভাগবতের সাক্ষাৎকার নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে অন্যান্য বহু দল এ বিষয়ে নির্দ্বিধায় মুখ খুলেছে।
যেমন সিপিআইএমের পলিটব্যুরো একটি বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘ইতিহাসের ভুলকে শোধরানোর নামে তিনি কার্যত হিন্দুদের আগ্রাসনকেই সমর্থন করেছেন। তিনি বলেছেন, হিন্দুরা একটি ‘যুদ্ধে শামিল’।’
বামপন্থী এ দলটি আরো বলেছে, তারা মনে করে, মোহন ভাগবত ধর্মের ভিত্তিতে চিহ্নিত ভারতের জনসংখ্যার একটি অংশের বিরুদ্ধে কার্যত সহিংসতার ডাক দিয়েছেন।
রাষ্ট্রীয় জনতা দলের নেতা ও এমপি মনোজ ঝা মন্তব্য করেছেন, ‘এই সুপ্রিমেসির বিষয়টি নিছক কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। গত কয়েক বছর ধরেই আসলে বিজেপি-আরএসএস সর্বত্র একটা কাল্পনিক ভয়, কাল্পনিক আতঙ্ক তৈরি করতে চাইছে। এটাও সেই ধারাবাহিকতার অংশ বলে মনে করি।’
তবে মোহন ভাগবতের বক্তব্যে সবচেয়ে কঠোর প্রতিক্রিয়া দিয়েছে এআইএমআইএম, যেটি প্রধানত একটি মুসলিম রাজনৈতিক দল হিসেবেই পরিচিত।
এআইএমআইএম নেতা ও এমপি আসাদউদ্দিন ওয়াইসি বলেছেন, ‘মুসলিমদের ভারতে থাকার বা নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস পালনের অনুমতি দেয়ার মোহন ভাগবত কে? আমরা ভারতীয়। কারণ সেটা আল্লাহর অভিপ্রায়।’
কোন সাহসে ভারতীয় মুসলিমদের নাগরিকত্বের ওপর তিনি শর্তারোপ করেন, এমন প্রশ্নও তোলেন ওয়াইসি।
তিনি বলেন, ‘নাগপুরের কয়েকজন কথিত ব্রহ্মচর্য পালনকারীকে তুষ্ট করতে ভারতের মুসলিমরা তাদের ধর্মবিশ্বাসকে অ্যাডজাস্ট করতে পারবে না।
ভাগবতের উদ্দেশ্যটা কী?
আরএসএসের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে মোহন ভাগবতকে কিছুটা উদারপন্থী বলেই মনে করা হয়। সাম্প্রতিক অতীতেও তিনি ভারতের মুসলিম সমাজের সাথে আলাপ-আলোচনার নানা উদ্যোগ নিয়েছেন।
নতুন বছরের শুরুতেই সংগঠনের মুখপাত্রে সাক্ষাৎকার দিয়ে তিনি ঠিক কী বার্তা দিতে চেয়েছেন, তা নিয়ে এখন চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
দিল্লিতে প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক সতীশ পদ্মনাভন বিবিসিকে বলছিলেন, ‘মোহন ভাগবতকে আমিও যথেষ্ঠ মডারেট বলেই মনে করি।’
‘কাশীর জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে মামলার সময় তিনি এমন কথাও বলেছিলেন, সব মসজিদের ভেতর আমাদের শিবলিঙ্গ খোঁজার দরকার নেই। আরএসএস প্রধান হিসেবে এটা বলার জন্য বেশ সাহস লাগে।’
কিন্তু আগামী বছরের গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনের আগে আরএসএস-বিজেপি এখন তাদের রাজনৈতিক স্ট্যান্ড কিছুটা বদলাতে চাইছে বলেই দ্মনাভনের ধারণা।
তিনি বলেন, ‘মোহন ভাগবতের সাক্ষাৎকার থেকে আমার মনে হচ্ছে, আপাতত আরএসএস দেশের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে আবার হার্ডলাইনে ফিরে যেতে চাইছে। আগামী ভোট পর্যন্ত দক্ষিণপন্থী দলগুলোর প্রচারে এটাই সম্ভবত প্রাধান্য পাবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০২৪-এর মে মাসে সাধারণ নির্বাচনের আগে চলতি ২০২৩ সালেও ভারতের অন্তত নয়টি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হবে।
দেশের সুপরিচিত আইন বিশেষজ্ঞ ও নালসার ইউনিভার্সিটির ভিসি ফায়জান মুস্তাফা মুসলিম সুশীল সমাজের এমনই একজন সদস্য, যিনি অতীতে বহুবার মোহন ভাগবতের বিভিন্ন পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন।
সেই ফায়জান মুস্তাফাও বিবিসিকে বলছিলেন, ‘ওনাকে মনে করিয়ে দেব, এই যে সুপ্রিমেসির কথা বলা হচ্ছে, সেটা কিন্তু হিন্দু ধর্মগ্রন্থেও আছে, যেখানে ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলা হয়েছে। একই ধরনের জিনিস নাৎসি জার্মানিতে বা ইসলামের ভেতরে সৈয়দ বংশীয়দের নিয়েও বলা হয়েছে। ফলে আরএসএস যদি দেশের সব নাগরিকের জন্য সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সেটা ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে এলে চলবে না। সেটা নিশ্চিত করতে হবে দেশের সংবিধানের ভিত্তিতে।
আরএসএসের সাফাই
সরসঙ্ঘচালকের সাক্ষাৎকার যে দেশ জুড়ে রীতিমতো বিতর্ক সৃষ্টি করেছে এবং সেটা সংগঠনের পক্ষেও খুব ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে না, সম্ভবত সেটা উপলব্ধি করেই ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লিখেছেন সিনিয়র আরএসএস নেতা রাম মাধব।
আরএসএস প্রধান নিজেদের মুখপাত্রে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, আর সেটির ব্যাখ্যা করে মূল ধারার একটি জাতীয় সংবাদপত্রে কলম ধরতে হচ্ছে আরএসএসের পরের সারির নেতাদের, এ ঘটনাও রীতিমতো নজিরবিহীন।
রাম মাধব তার নিবন্ধে ওই স্বীকারই করে নিয়েছেন, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম মোহন ভাগবতের বক্তব্যকে ‘ভুল বুঝেছে’।
‘ভাগবত’স ভারত’ শীর্ষক ওই নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘প্রতিটি মানুষের সংস্কার, প্রেজুডিস বা ভাবনার নিরিখে এক একটা শব্দের অর্থ এক এক জনের কাছে এক এক রকম হয়। ভাগবতের ভারতকে বুঝতে হলে ওই সংস্কারের চশমা চোখ থেকে সরিয়ে বিষয়টাকে দেখতে হবে।’
রাম মাধব আরো যুক্তি দিয়েছেন, মোহন ভাগবত আসলে ওই সাক্ষাৎকারে বলতে চেয়েছেন, ‘আমরা অন্যদের সাথে একসাথে বাস করতে পারব না’ এই মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে।
‘এটা আসলে সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কোনো হিন্দু যদি এরকম ভাবেন, তাহলে সেটা তাকেও বিসর্জন দিতে হবে।’
‘একজন কমিউনিস্ট যদি এ ধরনের ভাবনার শরিক হন, তাহলে তাকেও সেটা ছাড়তে হবে।’
সূত্র : বিবিসি