এয়সান দৌলত বেগম সাহেব ছিলেন মেজাজি ও কৌশলী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী ও বুদ্ধিমতী একজন নারী। তার পরামর্শেই বেশির ভাগ কাজ করা হতো।
মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবর, নিজের স্মৃতিকথা ‘বাবরনামা’-তে তার নানি সম্পর্কে এমন কথা বলেছেন।
ওই বইয়ের মুখবন্ধে বলা হয়েছে, ১৪৯৪ সালে বাবরের বাবার মৃত্যুর পর বিভিন্ন রাজনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে এয়সান দৌলত বেগম, বাবরের পথপ্রদর্শক ও সাহায্যকারী হিসেবে পাশে ছিলেন।
প্রকৃত ক্ষমতা এবং কার্য পরিচালনার ভার তার হাতে ছিল।
মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে দেখা গেছে, সিংহাসনের উত্তরাধিকারী পুরুষদের একেকজনের দৃঢ় ব্যক্তিত্বের দিগ্বিজয়ী সম্রাট হয়ে ওঠা কিংবা তাদের মানস তৈরি অথবা পেছন থেকে তাদের পরিচালনায় ছিলেন কোনো এক অসামান্য নারী, যারা বুদ্ধিমত্তা এবং বিচক্ষনতার মাধ্যমে অর্জন করেছিলেন অগাধ শ্রদ্ধা আর বিপুল প্রভাব।
রাজকীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বা যুদ্ধবিগ্রহে তাদের অনেকের অংশগ্রহণ ছিল, ডিক্রি বা ফরমান জারি, সঙ্কেত দেয়া বা পরোয়ানা প্রদানসহ নানা ধরনের সরকারি নথি জারি করার ক্ষমতাও ছিল কারো কারো।
মোগল সম্রাট তার মায়ের পালকি বহন করতেন
মোগল আমলে, ফার্স্ট লেডি হতেন সাধারণত সম্রাটের মা, সম্রাটের স্ত্রী নন। সম্রাটের মায়ের মৃত্যুর পর তার জায়গা রানী নিতে পারতেন।
বাবর থেকে শুরু করে সব মোগল সম্রাটেরই মায়ের প্রতি সম্মানের বিষয়টি সুবিদিত ছিল।
তবে, এক্ষেত্রে নুরজাহান ও মমতাজ মহল অবশ্য ব্যতিক্রম ছিলেন। তারা রানী হিসেবেই ফার্স্ট লেডির মর্যাদা পেয়েছিলেন।
ইতিহাসবিদ এস এম এডওয়ার্ডস, ‘বাবর, ডায়েরিস্ট অ্যান্ড ডিসপোট’-এ লিখেছেন যে নানি এয়সান দৌলত বেগম এবং মা কুতলুঘ নিগার সম্রাট বাবরের জীবন গঠনে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন।
বাবর তার বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা তার মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন।
রাধে শ্যাম তার ‘বাবর’ বইয়ে লিখেছেন, ‘যুদ্ধে সময় মা কুতলুঘ নিগার খানম বাবরের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা ছিলেন।’
তুর্কি ও ফারসি ভাষায় শিক্ষিত নিগার খানম তার ছেলে বাবরের বেশিরভাগ অভিযানে এবং রাজত্বকালে তার সাথে ছিলেন।
বাদাখশান ও ট্রান্সএক্সোনিয়ার মতো দূরবর্তী অভিযানে বাবর তার স্ত্রী অর্থাৎ হুমায়ুনের মা মাহাম বেগমকেও পাশে পেয়েছিলেন।
ইতিহাসবিদ রোমারগুডেনের মতে, মাহাম শক্তিশালী ও প্রাণোচ্ছল নারী ছিলেন এবং ধারণা করা হয় বাবর তাকে কখনো কোনো কিছু করতে নিষেধ করেননি।
বিবি মুবারাকাও ছিলেন বাবরের কাঙ্ক্ষিত স্ত্রীদের একজন। তাকে বিয়ে করার ফলে ইউসুফজাই বংশের সাথে বাবরের সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় এবং আফগানিস্তানের ওপর তার দখল জোরদার হয়।
তবে মাহাম বেগম উচ্চ পদে আসীন ছিলেন এবং সিংহাসনে তাকে তার স্বামীর সাথে বসতে দেয়া হতো।
গবেষক এস এ তিরমিজি লিখেছেন, ‘হুমায়ূন তার মা মাহাম বেগমের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার কারণে সৌভাগ্যবান ছিলেন। মাহাম বেগম সুশিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী ও বড় মনের অধিকারী ছিলেন।’
সম্রাট হুমায়ুনের বোন গুল বদন বেগম ‘হুমায়ুন নামা’ লিখেছিলেন, যা ছিল ১৬ শতকের মোগল ভারতে নারীর লেখা একমাত্র বই।
মাহাম বেগম, গুল বদনকে দেখাশোনা করতেন এবং তিনিই তাকে পড়ালেখা শিখিয়েছেন।
যখন হুমায়ুনকে বাদাখশানের গভর্নর হিসেবে প্রথম দায়িত্ব দেয়া হয়, তখন তার প্রশিক্ষণের সময়ে মাহাম বেগম ছেলের সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
হুমায়ুনকে রাজ সিংহাসনের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে গড়ে তুলতে মাহাম বেগমের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল।
লেখক রুবি লাল ব্রিটিশ লেখক এ এস বেভারিজকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, ‘স্ত্রী এবং রানী মা দুই ভূমিকায় মাহাম বেগমকে প্রজ্ঞা, মর্যাদা ও কর্তৃত্বের সমন্বয়ে একজন বিচক্ষণ নারী বলে মনে করা হতো। যিনি তার সন্তানদের নানা ধরনের পরামর্শ ও নির্দেশনা দিতে পছন্দ করেন। নেতৃত্ব দেয়া এবং তার পরিবারের নাম ও সম্মান বজায় রাখাকে তিনি তার কর্তব্য বলে মনে করতেন।’
এর বাইরে রাজনৈতিক বিষয়ে হামিদা বানু বেগমের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ, যিনি অনেক কষ্টে হুমায়ূনকে বিয়ে করতে রাজি হন।
এই ঘটনাটি ‘হুমায়ুন নামা’-তে বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে- ‘৪০ দিন ধরে হামিদা বানু বেগম অনিচ্ছুক (বিয়ে করতে) ছিলেন এবং তিনি কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত আমার মা দিলদার বেগম তাকে বলেন যে তার তো কাউকে না কাউকে বিয়ে করতেই হবে। তাহলে রাজার চেয়ে ভালো আর কে হতে পারে?’
উত্তরে বেগম বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি তাকেই বিয়ে করব যার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে পারব। তাকে বিয়ে করব না, যার পা পর্যন্ত আমার হাত পৌঁছাবে না। আমার মা তাকে অনেক উপদেশ দিয়ে অবশেষে রাজি করান।’
তাকে মরিয়ম মাকানি উপাধি দিয়েছিলেন তার ছেলে সম্রাট আকবর।
বিয়ের পর হামিদা বানুকে হুমায়ুনের সাথে দীর্ঘ সময় প্রবাসে কষ্টকর সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
সিন্ধুর অমরকোটে আকবরের জন্মের এক বছরের মধ্যে তাকে একজন ধাত্রীর কাছে রেখে, তিনি হুমায়ুনের সাথে কান্দাহার এবং তারপর পারস্যের বিপদজনক যাত্রায় অংশ নেন। হুমায়ুনের আস্থাভাজন আমির মুনাইম খানের নাতনির সাথে আকবরের বিয়ের ব্যবস্থা করে বৈরাম খানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তারা একটি রাজনৈতিক জোট গঠন করেন।
হামিদা বানু রাজকীয় হারেমে উচ্চ পদে অধিষ্ঠ ছিলেন এবং তার ফরমান জারি করার অধিকার ছিল।
‘হুমায়ুন নামা’ অনুসারে, রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানের পর, যাকে জশন-ই-জুলুস বলা হয়, সম্রাট প্রথমে তার মা এবং পরে অন্য আত্মীয়দের সাথে দেখা করতেন।
ইতিহাসবিদ আবুল ফজল লিখেছেন, আকবর তার মা মরিয়ম মাকানিকে খুব সম্মান করতেন এবং তাকে স্বাগত জানাতে রাজধানী থেকে বের হয়ে যেতেন।
একবার আকবরের মাকে পালকিতে করে লাহোর থেকে আগ্রায় নিয়ে যাওয়া হয়।
আকবর, যিনি তার সাথে ভ্রমণ করছিলেন, তার পালকি কাঁধে করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যেতেন এবং নদীর এক তীর থেকে অন্য তীরে নিয়ে যেতেন।
‘আকবরনামা’-তে লেখা আছে, একবার শাহজাদা সেলিমকে অতিরিক্ত মদ্যপান ও খারাপ সঙ্গের কারণে সম্রাট আকবর কিছু সময়ের জন্য তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে মায়ের অনুরোধে সেটি প্রত্যাহার করে নেন।
যুবরাজ সেলিম একবার বিদ্রোহ করেন এবং এলাহাবাদে রাজকীয় অবস্থান গ্রহণ করেন। বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য আকবর তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত উপদেষ্টা আবুল ফজলের সাহায্য নেন। কিন্তু পথে আবুল ফজলকে হত্যা করেন সেলিম। আকবর খুবই কষ্ট পান এবং ক্ষুব্ধ হন।
মরিয়ম মাকানি এবং গুল বদন বেগম, সেলিমকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য সম্রাটের কাছে অনুরোধ করেন।
আকবর তাদের অনুরোধ মেনে নেন এবং তার ফুফু গুল বদন ও স্ত্রী সালিমা সুলতানা বেগমকে বলেন, রাজকুমার যেন তার কাছে ক্ষমা চান এবং তাকে যেন আদালতে হাজির করা হয়।
পরে স্ত্রী সালিমা ও সৎ মা মাহ চুচাক বেগমের মেয়ে বখতুল-নিসা দু’জনের মধ্যে মীমাংসা করেন।
ওই সেলিম, সম্রাট জাহাঙ্গীর হন।
তুজুক-ই জাহাঙ্গীরীর মতে, জাহাঙ্গীর তার মা যোধাবাইকে যার আনুষ্ঠানিক নাম রাখা হয়েছিল মারিয়াম-উজ-জানি, তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। তার বাড়িতে সম্রাটের ওজন করা হতো এবং রাজকুমারদের বিয়ে দেয়া হতো।
বোনদের প্রতি ভালবাসা
মাহাম বেগমের মৃত্যুর পর বাবর তার বড় বোন খানজাদা বেগমকে বাদশাহ বেগম উপাধি দিয়ে হারেমের প্রধান করেন। গুল বদন তাকে ‘প্রিয়তম নারী’ বা ‘আকে জনম’ বলে সম্বোধন করতেন।
হুমায়ুনের শাসনামলে তিনি ওই পদে বহাল ছিলেন। ওই সময় খানজাদা বেগম হুমায়ুন এবং তার ভাই হিন্দাল, কামরান ও আসকারির মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করেন।
গুল বদন বেগম ‘হুমায়ুন নামা’-তে অনেক উদাহরণ দিয়েছেন যেখানে বোনদের প্রতি বাবর এবং হুমায়ুনের ভালবাসার চিত্র ফুটে ওঠে। বোন বিধবা হলে ভাই তাকে আশ্রয় দিতে সদা প্রস্তুত থাকতেন।
গুল মিশকা বেগম বিধবা হলে হুমায়ুন তাকে আগ্রায় ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেন। জাহাঙ্গীর তার স্মৃতিচারণে তার বোন শুকর-উল-নাসা বেগম এবং উরম বানু বেগমের কথা স্নেহের সাথে উল্লেখ করেছেন, যদিও তারা ভিন্ন মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মোগল পরিবারের মেয়েরা
মোগল সম্রাটরা তাদের মেয়েদের খুব ভালোবাসতেন। তাদের শিক্ষিত করে তুলতে এবং প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে নানা ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হতো।
কিন্তু তাদের অনেকেই, বিশেষ করে আকবরের আমলে তারা অবিবাহিত থাকতেন। মানুচির মতো অনেক লেখক এবং বিদেশে ভ্রমণকারীরা আকবরকে ওই ঐতিহ্যের সূচনা করার জন্য দায়ী করেন।
তবে অনেক লেখক এতে একমত হননি। তাদের মতে, আকবর তার বোন ও কন্যাদের যোগ্য পুরুষদের সাথে বিয়ে করাতেন। তবে আকবর নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে পছন্দ করতেন না।
শাহজাহানের সময় পর্যন্ত রাজকন্যাদের বিয়েতে কিছু বিধিনিষেধ ছিল। সেটি সম্ভবত সিংহাসনের দাবিদারদের সংখ্যা সীমিত করার জন্য করা হয়েছিল।
কিন্তু আওরঙ্গজেব তার কয়েক মেয়ে এবং ভাতিজিকে ভাই-বোনের সন্তানদের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন।
মোগল রাজকন্যাদের শিক্ষিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হতো।
বাবরের মেয়ে, যিনি সাহিত্যকর্মে নিয়োজিত ছিলেন, তিনি ছিলেন গুল বদন বেগম। তিনি ‘হুমায়ুন নামা’ লেখার জন্য ব্যাপক পরিচিত ছিলেন।
আকবর নামা অনুসারে, হুমায়ুনের স্ত্রী বেগা বেগম, যিনি হাজি বেগম নামেও পরিচিত, একজন শিক্ষিত নারী ছিলেন। তিনি লেখালেখি করতে জানতেন এবং ওষুধ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখতেন।
হুমায়ুনের ভাতিজি সালিমা সুলতানা বেগম ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে পারদর্শী ছিলেন।
সম্রাট আকবরের নিজস্ব আনুষ্ঠানিক শিক্ষা খুবই কম ছিল। তবে তিনি শিক্ষাদীক্ষা বিস্তারে এবং রাজকুমার ও রাজকন্যাদের শিক্ষিত করে তোলার ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলেন।
কথিত আছে, তিনি তার ফতেহপুর সিক্রি প্রাসাদে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মোগল রাজকন্যাদের প্রাসাদের অভ্যন্তরে শিক্ষিত নারী বা বয়স্ক পুরুষদের দ্বারা শিক্ষা দেয়া হতো।
আকবরের শাসনামলে জান বেগম নামে এক নারীকে কুরআনের তাফসির লেখার জন্য সম্রাটের পক্ষ থেকে পাঁচ হাজার দিনার পুরস্কার দেয়া হয়েছিল।
শাহজাহান এবং রানী মমতাজ বেগমের মেয়ে জাহান আরা তার জ্ঞান ও মাধুর্যের জন্য পরিচিত ছিলেন। চিশতি রাজবংশের প্রবীণদের উল্লেখ করে তার লেখা ‘মনুস-উল-আরওয়াহ’ আজও গবেষকদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি বই।
মোগল রাজকন্যাদের মধ্যে জাইব-উল-নিসা একজন খ্যাতনামা কবি এবং সাহেব দেওয়ান ছিলেন। তার ফারসি গজলগুলো অত্যন্ত সমাদৃত হয়েছিল।
ইতিাহসবিদ সোমা মুখার্জি লিখেছেন, রানী যদি নিঃসন্তান হন তবে তাকে অন্য নারীর সন্তান দত্তক নেয়ার অনুমতি দেয়া হতো।
হুমায়ুনের মা মাহাম বেগম হুমায়ুনের জন্মের পর চার সন্তানকে হারান। পরে হুমায়ুনকে লালন পালন করেন সম্রাট বাবরের দ্বিতীয় স্ত্রী দিলদার বেগমের সন্তান হিন্দাল এবং গুল বদন।
আকবরের প্রথম স্ত্রী রুকাইয়া সুলতান বেগম নিঃসন্তান ছিলেন। পরে শাহজাদা সেলিমের ছেলে খুররম জন্ম নেয়ার পর তাকে রুকাইয়া সুলতানের হাতে তুলে দেয়া হয়।
আরেক ইতিাহসবিদ ইরা মুখোতির মতে, আকবর বিধবাদের পুনরায় বিয়ে করতে উৎসাহিত করতেন। তিনি বিধবা ও বিবাহবিচ্ছেদকে কলঙ্ক হিসেবে বিবেচনা করেননি।
তার সামনে খানজাদা বেগমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিল, যিনি দু’বার তালাকপ্রাপ্ত ছিলেন। তারপরও উচ্চ সম্মানে অধিষ্ঠ ছিলেন।
শুরুতে সতীদাহ প্রথা চর্চাকারী নারীদের প্রশংসা করলেও পরে তিনি ওই প্রথাকে ঘৃণা করতে শুরু করেন এবং যারা এর সমর্থন করতেন তাদের সমালোচনা করেন।
আবুল ফজলের মতে, ছেলে সন্তান জন্মের সময় সম্রাট আকবর যেমন বিশাল উদযাপন করতেন ঠিক মেয়ে সন্তান জন্মের সময়ও তিনি ধুমধাম আয়োজনের আদেশ দিতেন।
সম্রাট আকবর সমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহ প্রথা অপছন্দ করতেন।
আকবর বিবাহ-সংক্রান্ত নিয়ম জারি করেন এবং শহরগুলোয় কোতোয়ালদের দায়িত্ব আরোপ করেন যেন যথাসম্ভব এ ধরনের প্রথা বন্ধ করা যায়।
মোগল সম্রাটদের সম্মান তাদের মা বা বোনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।
বাবর যখন রাজা ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করেন, তখন তিনি তার মাকে সম্মান করেছিলেন, তাকে জমি এবং একটি প্রাসাদ দিয়েছিলেন।
বাবর তাকে ‘মা’ বলে ডাকতেন। কিন্তু তারা সম্রাটের খাবারে বিষ মেশানোর ষড়যন্ত্র করেছিল এমন তথ্য পাওয়া যায়।
সম্রাট খুব কম খাবার খেয়েও অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে জানা যায়, ইব্রাহিমের মায়ের দেয়া বিষের কারণে এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাবর তার প্রতি নম্র ছিলেন।
ষড়যন্ত্রে জড়িত অন্যদের হত্যা করা হলেও ওই নারীকে কাবুলে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু রক্ষীদের হাত থেকে পালিয়ে তিনি সিন্ধু নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
নিজের মা ছাড়াও সম্রাট হারেমের অন্য জ্যেষ্ঠ নারীদেরও সম্মান করতেন। বাবর নিজে প্রায়ই তাদের কাছে যেতেন। তাদের কেউ এসেছে খবর পেলে তিনি তাদের স্বাগত জানাতে মাঝে মাঝে পায়ে হেঁটে বের হতেন।
‘হুমায়ুন নামা’-তে লেখা আছে, তিনি শুক্রবারে বয়স্ক নারীদের সাথে দেখা করতেন।
আরো লেখা হয়েছে, ‘একবার খুব গরম পড়েছিল। রানী বললেন, বাইরে তাপের স্রোত বইছে, ওই এক শুক্রবার সেখানে না গেলে কি হবে? উত্তরে বাবর বললেন, যাদের বাবা-ভাই নেই, তাদের মন যদি খুশি না হয়, তবে আমাকেই তা করতে হবে।’
তার বাবার মতো, হুমায়ুন ব্যক্তিগতভাবে হারেমের বয়স্ক নারীদের সাথে দেখা করতেন এবং তাদের সাথে সদয় হয়ে কথা বলতেন। তার সম্মানে অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হতো।
আকবর তার দাদি গুল বদনকেও খুবই ভক্তি করতেন, তার অনুরোধেই গুল বদন ‘হুমায়ুন নামা’ লেখেন।
জমি, অর্থ ও দাতব্য
বাবর হারেমের নারীদের পরগণা দেয়ার প্রথা চালু করেন। পরগনা হলো কয়েকটি মৌজা নিয়ে গঠিত এলাকা যেখান থেকে রাজস্ব আদায় করা হতো।
তিনি ইব্রাহিম লোদির মাকে সাত লাখ টাকার একটি পরগনা দিয়েছিলেন। তিনি হারেমের নারীদের জন্য কিছু বাড়ি এবং জমিও বরাদ্দ করেছিলেন।
হুমায়ুন সুফি ভোজে হারেমের নারীদের আশরাফি ও শাহরাখী আকারে মূল্যবান উপহার দিতেন।
এই অর্থ দিয়ে, তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজন ছাড়াও, রাজকীয় নারীরা দাতব্য কাজ এবং ভোজের আয়োজন করতেন।
বাবরের মৃত্যুর পর মাহাম বেগম দিনে দু’বেলা মানুষদের খাওয়াতেন।
তিনি ১৫৩০ সালে হুমায়ুনের সিংহাসনে আরোহণের জন্য একটি দুর্দান্ত ভোজের আয়োজন করেন এবং সাত হাজার লোককে খাওয়ান।
হুমায়ুনের স্ত্রী হাজি বেগমও তার ব্যক্তিগত ভাতার একটি বড় অংশ দাতব্য কাজে ব্যয় করতেন।
তিনি মক্কায় হজে প্রচুর দান-খয়রাত করেন। হারেমের এই রাজকীয় নারীরা প্রিয়জনকে বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোয় মূল্যবান উপহার দিতেন।
পালক মায়েরাও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না
প্রকৃত মা ছাড়াও মোগল পরিবারে পালক মাও ছিলেন। এই পালক মায়েরা, যাকে বলা হয় অঙ্গাস, তারা মোগলদের অত্যন্ত সম্মানের পাত্র ছিলেন।
আকবরের পালক মা মাহিম অঙ্গাস ছিলেন সম্রাটের পর সবচেয়ে শক্তিশালী নারী।
জাহাঙ্গীর তার পালিত মায়ের মৃত্যুর কথা তার স্মৃতিকথা ‘তাজক জাহাঙ্গীরী’-তে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘কুতুবউদ্দিন খান কোকার মা, যিনি আমাকে লালন-পালন করেছেন এবং আমার কাছে মায়ের মতো ছিলেন। তিনি আমার আপন মায়ের চাইতেও সদয় ছিলের। কিন্তু আল্লাহর রহমত নিয়ে আমার ওই মা চলে গেছেন। তার লাশ বহনকারী খাটিয়ার যেদিকে পা ছিল, সেই অংশটি আমি কাঁধে নিয়েছি এবং তাকে কবর পর্যন্ত বয়ে নিয়ে গিয়েছি। তীব্র যন্ত্রণায়, কয়েক দিন ধরে কিছু খেতে ইচ্ছে করেনি, জামাকাপড় বদলাতেও মন চায়নি।’
রাজকীয় নারীর শক্তি
ইতিহাসবিদ ফজল হুসেন লিখেছেন, মোগল হারেমে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, ইরানি, তুরানি, পর্তুগিজ এবং অনেক ইউরোপিয় জাতীয়তা এবং বিভিন্ন দেশের নারীরা ছিলেন।
তারা পরোক্ষভাবে তাদের স্বামী ও অন্যদের বিভিন্ন ভাষা শেখাতেন এবং তাদের বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও শিল্পের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজদীপ সিনহা, অন্নপূর্ণা সিংহদাস গবেষণাপত্রে দেখেছেন, মোগল ভারতে রাজবংশের নারীদের অনেক আইনি অধিকার এবং অসাধারণ ক্ষমতা ছিল।
তাদের ডিক্রি বা ফরমান জারি, সঙ্কেত দেয়া বা পরোয়ানা দেয়াসহ নানা ধরনের সরকারি নথি জারি করার ক্ষমতা ছিল।
শাহজাহানের শাসনামলে শাহী সীলমোহরটি রানী মমতাজ মহলের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
মমতাজ মহলের মৃত্যুর পর এটি বেগম সাহেবা অর্থাৎ মেয়ে জাহান আরাকে দেয়া হয় ।
ঝাড়ুকা দর্শনে সম্রাটের সাথে জাহাঙ্গীরের রানী নূরজাহানকেও দেখা গিয়েছিল।
এভাবে প্রশাসন কার্যত নূরজাহানের হাতে চলে আসে এবং তার সম্মতি ছাড়া রাষ্ট্র সংক্রান্ত কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হতো না।
জাহাঙ্গীরের রাজকীয় আদেশের সাথে নুরজাহানের সীলমোহর এবং স্বাক্ষরও লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল।
জাহাঙ্গীরের সময়কার রৌপ্য ও স্বর্ণমুদ্রায়ও নুরজাহানের নাম খোদাই করা ছিল। জাহাঙ্গীরের নির্দেশে তিনি ১০০টি রত্ন পান। তাকে নুরজাহান বাদশা বেগম বলা হতো।
জার্মান প্রাচ্যবিদ অ্যান মেরি শ্মাল জাহাঙ্গীরের এই কথাগুলো লিখেছেন, ‘আমি নুরজাহানকে প্রশাসনের দায়িত্ব অর্পণ করেছি, আমি রক্ত মাংসের মানুষ ছাড়া আর কিছুই না।’
কিন্তু ভাষ্যকার আলেকজান্ডার ডাও বলেছেন, ‘নুরজাহান সমস্ত বিধিনিষেধ ও প্রথা ভেঙে জাহাঙ্গীরের দুর্বলতার চেয়ে নিজের যোগ্যতায় ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন।’
সূত্র : বিবিসি