মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছেন, তার সদ্যসমাপ্ত ভারত সফরে তিনি ভারতের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং একটি মুক্ত সংবাদমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে আলোচনায় তুলেছিলেন।
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ২০টি অর্থনীতির জোট জি-২০-র শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতেই বাইডেন ভারতে গিয়েছিলেন। ওই সম্মেলনের ফাঁকে তিনি মোদির সাথে দ্বি-পক্ষীয় বৈঠকও করেন।
অবশ্য রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) সম্মেলন শেষ হয়ার আগেই তিনি ভারত থেকে ভিয়েতনামের উদ্দেশে রওনা দেন।
ভিয়েতনামের হ্যানয়ে একটি সাংবাদিক সম্মেলনেই প্রেসিডেন্ট বাইডেন ওই মন্তব্যটি করেন। সেখানে তিনি আরো জানান, ভারত-মার্কিন সম্পর্ককে কিভাবে আরো শক্তিশালী করে তোলা যায় তা নিয়ে মোদির সাথে তার ‘বিস্তারিত আলোচনা’ হয়েছে।
এর আগে হোয়াইট হাউস সূত্রেও বলা হয়েছিল, দিল্লিতে মোদি-বাইডেন বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি যৌথ সাংবাদিক বৈঠক আয়োজনের অনুরোধ জানানো হলেও ভারত তাতে রাজি হয়নি।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান আরো জানিয়েছিলেন, তারা প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও প্রধানমন্ত্রী মোদির বৈঠকের সময় আনুষ্ঠানিক সাংবাদিক সম্মেলন না-হোক, অন্ততপক্ষে একটি ‘প্রেস পুল স্প্রে’-র ব্যবস্থা করারও আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ওই অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করা হয়।
এই ধরনের ‘প্রেস পুল স্প্রে’ হোয়াইট হাউসে নিয়মিতই হয়। যেখানে একঝাঁক সাংবাদিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বা সফররত বিশ্বনেতাদের প্রশ্ন করার সুযোগ পান।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র অবশ্য জানিয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভারতে আসাটা কোনো পূর্ণাঙ্গ দ্বি-পক্ষীয় সফর ছিল না। তাই শুধু আলাদা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজনেরও কোনো প্রশ্ন ছিল না।
তবে প্রেসিডেন্ট বাইডেন নিজেই ভিয়েতনামে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ভারতে যেভাবে মিডিয়া বা সংবাদমাধ্যমের সাথে আচরণ করা হচ্ছে তাতে তার প্রশাসন মোটেই সন্তুষ্ট নয়।
‘ভারতে সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত’
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমলে ভারতের মানবাধিকার পরিস্থিতির ক্রমশ যে অবনতি হচ্ছে, অ্যাক্টিভিস্ট ও অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা বহুদিন ধরেই এ কথা বলে আসছে।
বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশটির ধর্মীয় সংখ্যালঘু, মূলত মুসলিমদের ওপর আক্রমণ অনেক বেড়ে গেছে বলে তারা জানাচ্ছেন। যদিও নরেন্দ্র মোদি সরকার এ সব অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে থাকে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অবশ্য পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভারতের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তারা সন্তুষ্ট নন।
হ্যানয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন, মানবাধিকারকে মর্যাদা দেয়াটা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমি সব সময় বলে থাকি। আর ওখানেও (দিল্লিতে) সেটা আমি উত্থাপন করেছি। একটা সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী দেশ গড়ে তুলতে সুশীল সমাজ ও মুক্ত সংবাদমাধ্যম যে কত বড় ভূমিকা পালন করতে পারে, তা আমি মোদিকে বলেছি।’
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার (আরএসএফ) মে মাসে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডমের যে সর্বশেষ সূচক বা ইনডেক্স প্রকাশ করেছে, তাতে ভারতের অবস্থান ১১ ধাপ নেমে গেছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের র্যাঙ্কিং এখন ১৬১।
বাইডেনসহ পাশ্চাত্য বিশ্বের নেতারা যেন ভারতের সাথে তাদের আলোচনায় এই বিষয়গুলো তোলেন, মানবাধিকার সংগঠনগুলো বহুদিন ধরেই এমন দাবি জানিয়ে আসছে।
কিন্তু পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চীনের উত্থানে রাশ টানার চেষ্টায় ভারতকে যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র খুব গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে দেখে, তাই এক্ষেত্রে মার্কিন প্রশাসন খুব সাবধানে পা ফেলতে চাইবে।
‘যুক্তরাষ্ট্র জ্ঞান দিতে চায় না’
গত জুন মাসেই নরেন্দ্র মোদি যখন রাষ্ট্রীয় সফরে যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিলেন, তখন মার্কিন প্রশাসন তাকে বিশাল অভ্যর্থনায় স্বাগত জানিয়েছিল।
ওই সফরের ঠিক আগেই মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান বলেছিলেন, কোনো দেশে অধিকার যখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে তখন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই নিজস্ব মতামত তাদেরকে বুঝিয়ে দেয়।
তিনি বলেছেন, ‘কিন্তু তা আমরা এমনভাবে মনে করি, যেন না মনে হয় যে যুক্তরাষ্ট্র জ্ঞান দিচ্ছে, কিংবা আমরা এমন কোনো ভাব দেখাই না যেন মনে হয় যে আমাদের নিজেদের দেশে কোনো সমস্যা নেই।’
হ্যানয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডর নিয়েও কথা বলেছেন, যে সমঝোতাটি দিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের সময়ই সম্পাদিত হয়েছে।
বাইডেন ওই করিডরকে একটি ‘গ্রাউন্ডব্রেকিং পার্টনারশিপ’ বা ‘যুগান্তকারী অংশীদারি’ বলেও বর্ণনা করেন।
ওই করিডরে সৌদি আরব বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে রেলপথে সংযুক্ত করার এবং তারপর সমুদ্রপথে একদিকে তাদের ভারতের সাথে ও অন্যদিকে ইউরোপের সাথে সংযুক্ত করার উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
বিশ্লেষকরা অনেকেই মনে করছেন, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবেই এই প্রকল্পের রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে।
এর আগে শুক্রবার (৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন দিল্লিতে পৌঁছান।
ওই দিন রাতেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির সরকারি বাসভবনে দ্বি-পক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বাইডেনকে প্রধানমন্ত্রী মোদি নৈশভোজে আপ্যায়িত করেন।
ওই আলোচনা বা নৈশভোজের পর সাংবাদিকরা দুই নেতাকে প্রশ্ন করার কোনো সুযোগই পায়নি।
বস্তুত ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে নরেন্দ্র মোদি আজ পর্যন্ত এককভাবে কোনো সাংবাদিক সম্মেলনই করেননি।
মোদি-বাইডেন দ্বি-পক্ষীয় বৈঠকের পর ভারতের পক্ষ থেকে জারি করা বিবৃতিতে জানানো হয়েছিল, দুই নেতাই বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতার অঙ্গীকার করেছেন।
তবে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও তাদের মধ্যে কথাবার্তা হয়েছে, এমন কোনো বিষয়ের উল্লেখ ওই বিবৃতিতে ছিল না।
সূত্র : বিবিসি