গণমাধ্যমকর্মীর জীবন; পথের বাঁকেবাঁকে যেন ওত পেতে থাকে হরেক কিসিমের অভিজ্ঞতা। কত রঙ আর গড়ন ভঙ্গিমায়; বিচিত্রতার ফুলদানিতে হাসি-কান্না, কখনো বা হতবাক করা ঘটনার মিশেল দিয়ে। এগুলো খবরওয়ালার নিত্যদিনের ছকে বাঁধা জীবনের পাঠশালায় অর্জিত অভিজ্ঞতার চলমান চালচিত্র।
দিনভর খাটুনি শেষে মেধার সবটুকু ঢেলে তৈরী রিপোর্ট নিউজ ডেস্কে পৌঁছে দিয়ে শান্তি-ক্লান্তির সুঘ্রাণ নিয়ে চিরচেনা ঘরে ফেরা খবরওয়ালার। মাসের পর মাস বেতন নেই, তাতে কি! ভুক্তভোগীর কষ্টের কথা শুন্য উদর নিয়ে অবিকল লেখার হিম্মত রাখেন ক’জনা? কেবল এটুকুই তো সুখ বেচারাদের। সেটাও ছিনতাই হয় প্রায়শ; অজ্ঞাত কারণে চেপে যাওয়া হয় কষ্টে বানানো রিপোর্ট। সে এক ভিন্ন এপিসোড।
বিগত দু’হাজার বিশ সালের করোনা ক্লান্তির প্রথম ধাক্কা সামলে ওঠার পরের ঘটনা। জনজীবনে কিঞ্চিৎ স্বাভাবিকতার সুবাতাস বইলে একদা বন্ধু-প্রেমের সাথে অভিজ্ঞতার ঝুলি স্ফীতির গরজে সঙ্গী হয়েছিলাম বেসুরো সঙ্গীতের।
এর আগের বছর সেপ্টেম্বরে হঠাৎ আছড়ে পড়া ‘অপারেশন ক্যাসিনো’ অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছিল। এতে বিনোদন পিয়াসীদের একটি অঙ্গন সঙ্কুচিত হওয়ায় কিঞ্চিত ভীড় বেড়েছিল পান্থশালায় পান-ভোজনের কেন্দ্রগুলোতে। সেখানকার হালফিল তথ্য জানাটাও ছিল খবরওয়ালা পেশার অন্যতম দায়। আর সেই গরজের দায় মেটাতেই একদা বিলম্বিত সন্ধ্যায় ব্যস্ত নগরের মাঝের সু-প্রসিদ্ধ পান্থকুঞ্জের আলো এবং আঁধারীতে চাক্ষুস হয়েছিল একুশ শতকীয় নতুন এক বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার ঊনপঞ্চাশ বছরে সমাগম আর ব্যাপ্তি বেড়েছে মসজিদের নগরী ঢাকায়। সময় গড়ানোর সাথে তালে-বেতালে বদলেছে এ নগরের ল্যান্ডস্কেপ; বদলেছে অনেক কিছু। তবে জাতির উষালগ্নে ঢাকাবাসীর যাপিত জীবনে বিনোদনের যে আটপৌরে আঙিনায় একদা আধুনিকতার তীব্র ঝলক লেগেছিল; সময়ের পথ পরিক্রমায়, ঈমানের খাতিরে বলতেই হবে, তা এগিয়েছে কিন্তু মাইলকে-মাইল।
সে যাই হোক, বন্ধুবর তরলের গরলে আকন্ঠ মেটাচ্ছিল তার নেশা, আমি মেটাচ্ছিলাম নিজের পেশার দায়। ছবি তোলা বারণ থাকায় সতর্ক কৌশলে জমা হচ্ছিল ঘটনার স্টিল আর চলমান ফুটেজগুলো। হিম হিম নিরবতার মাঝে টেবিলে টেবিলে হালকা টুংটাং শব্দ আর ওয়েটারদের পেশাদারী আনাগোনার মাঝে শুরু হয়েছিল বর্ণিল ঝলমলে স্টেজে প্রসাধন চর্চিত সুকন্ঠি আপ্সরীদের সুর ঝংকার। তার সাথে মানানসই অর্কেস্ট্রেশন। বাইরে দুনিয়ার যাবতীয় জীবন যন্ত্রণা এক ফুৎকার নিভিয়ে দেবার যেন কত আয়োজন!
বন্ধু ফিসফিসয়ে জ্ঞান দিল, চেয়ে দেখ ব্যাটা- জীবনেও দেখিসনি! চিনে রাখ, এখন যিনি টাকা ওড়াচ্ছেন- তিনি জনবান্ধব এক পোষাকী বাহিনীর বড় কর্তা। আর ওই যে, স্টেজে ওঠার জন্য পায়তাড়া করছেন, উনি হলেন প্রজাতন্ত্রের একজন কেউকেটা; দরকারী কাজে আমরা প্রায়শ উনার কাছে গিয়ে থাকি। আর ওই ডানে.. এভাবে চললো ধারাবিবরণী।
হ্যাঁ, অস্বীকারের কারণ নেই। এমনটা আগে কখনও দেখিনি। বার-সিংগার গান গাইছে; তার মাথার উপর উচ্চ মূল্যমানের কারেন্সি নোটের আস্ত খোলা বান্ডেল। সেখান থেকে আস্তে আস্তে নোটগুলো ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে গানওয়ালীর মাথার চারপাশে; যেন টাকা দিয়ে তাকে গোসল করানো হচ্ছে।
তো সেই গোসল পর্বে অতঃপর এলেন অন্যজন। তিনি ছড়ালেন আগের জনের দ্বিগুন। এভাবে চলতে থাকলো। সাথে আশপাশ থেকে খুচরো তো আসছিলোই। গান চললো পালাক্রমে; টাকার স্রোতের ফল্গুধারা চললো যেন তার সাথে পাল্লা দিয়ে। এক পর্যায়ে গানের স্টেজ টাকায় ছয়লাব, পা ফেলারও জায়গা রইল না। স্টেজ ছাপিয়ে গড়িয়ে পড়লো বাইরেও। বার এটেন্ডেন্টগণ ব্যাগ নিয়ে টাকা কুড়াতে ব্যস্ত। এমনই চলে নাকি প্রতিরাতে। কিমাশ্চার্যম!
গান চলছিল, চলছিল পানভোজন আর ক্ষণিক বিরতিতে পেছনের ডিলাক্স কক্ষে মুল্যবান সুধীজনদের সসন্মান যাতায়াত। কি নেই ওখানে? চৌব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয়- স ব!
চোখ ধাঁধিয়ে গেলে উঠে পড়া গেল একসময়। রাতের নিরব ঢাকার অদেখা এক অভিজ্ঞতা নিয়ে গরমের মধ্যরাত পেরিয়ে শেষমেষ পথে এলাম আমরা দু’জন।
এই যে ওড়ানো টাকা, এগুলো কোন গৌরীসেনের? আর এই নটবরের গেষ্ঠিরা কি সেই গৌরীর পুত্র পৌত্র প্রপৌত্রগণ কেউ। দেশের মানুষ না খেয়ে হাজারো কষ্টে দিন কাটায়; আর গৌরীসেনের এই গোষ্ঠিরাে আইনের শাসনওয়ালা এই দেশে এভাবে বাতাসে ওড়ানোর মত এত বিপুল আংকের টাকা পায় কোথায়?
ফেরার পথে জিরো পয়েন্টের কাছে চেখে পড়েছিল রাতের অতন্দ্র প্রহরী একদল পুলিশ সদস্যের পেশাদার নজরদারী। অবাক চোখে তাকিয়ে দেখেছিলাম, ধূলোর মেঘ উড়িয়ে ধাবমান যন্ত্রদানব আর গভীর রাতে চলাচলকারী নগরবাসীর সন্দেহ জাগানিয়া ভাবগতিকের প্রতি তাদের কড়া সতর্কতা।
শান্তিপ্রিয় নাগরিকের রাত্রিযাপন নিরাপদ করতে জাতির সুশৃঙ্খল এই সন্তানেরা যখন ধূলিধূসরিত রাজপথে গলদঘর্ম; ঠিক তখন, ওরা জানলোও না- ওদেরই কতিপয় চরিত্রহীন মদ্যপ উপরওয়ালা সাঙ্গোপাঙ্গোসহ পানশালার জান্তব নরকে প্রিয়দর্শিনী বার-সিংগারের পেলব দেহবল্লরী ঢেকে দিতে চাইছিল জাতির পিতার নির্বাক ছবিসম্বলিত বাংলাদেশের উচ্চ মূল্যমানের কারেন্সি নোটের আবরণে।
সত্যি সেলুকাস! বড়ই বিচিত্র এই দেশ!
লেখকঃ বশির আহমেদ।
মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও সাংবাদিক।