আলতাফ হোসেনঃ আজ শনিবার পহেলা ডিসেম্বর। সময়ের ভেলায় চড়ে আবারও এলো মহান বিজয়ের মাস। হেমন্তের নবান্ন আমোদন আর কুয়াশার চাদর জড়ানো এ মাসের সাথে জাতীয় জীবনের সম্পর্ক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আবেগের। আমাদের লাল-সবুজ পতাকা, নিজস্ব মানচিত্র, নিজস্ব সত্তা-পরিচয় ও বিকাশের বীজ এ মাসেই পূর্ণরূপে অংকুরিত হয়েছিল।
১৯৭০ সাল পর্যন্ত ইংরেজি বছরের শেষ মাসটির তেমন আবেদন ছিল না আমাদের কাছে। পরের বছর ১৯৭১ সাল থেকেই এর সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে যায় বাংলাদেশের নামটি। পৃথিবীর একমাত্র বদ্বীপ রাষ্ট্রের নিজস্ব ভূখন্ড, নিজস্ব মানচিত্র, নিজস্ব প্রশাসন, স্বশাসিত রাষ্ট্রযন্ত্র সবকিছুই যেন ডিসেম্বরের বদৌলতে। হয়তো ডিসেম্বর না হলে আমাদের স্বপ্ন কেবলই ফানুস হয়ে উড়তো। তাই তো এ মাস এলেই দেশপ্রেমিক জনতাসহ জাতীয় জীবনের সর্বত্র লাগে উদ্দীপিত আবেগের ঢেউ। এ দিনের সূর্যটাও অন্য দশটি দিনের চেয়ে একটু ভিন্ন আবেশ মাখা। নবজাগৃতির আলোকমালা। দী একচল্লিশ বছরের ব্যবধানেও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সমুজ্জ্বল, চরম আকাঙ্ক্ষা ও পরম প্রাপ্তির প্রতীক মাসটি।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই ডিসেম্বরেই লাল-সবুজ ক্যানভাসের বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। শিথানে তার হিমালয় পর্বত আর পাদপ্রান্তে বিশাল পানিরাশির বঙ্গোপসাগর। ঊনিশশ’ একান্তর সালে টানা নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও অসংখ্য শহীদের তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় এ দেশের স্বাধীনতা। বাংলার দামাল ছেলেরা পরাধীনতার শেকল ছিঁড়ে এ স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের একটি প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পর্যায়ক্রমিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায় ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলনের চরম পর্যায়ে স্বাধীনতার আওয়াজ ওঠে। দাবি আদায়ের আন্দোলনে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ রাজপথে নেমে আসে। বিজয়ের জন্য লড়াকু জনতা শরীরের শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত সংগ্রামের প্রস্তুতি নেয়।
সমকালীন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বলে থাকেন, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে মুক্ত করার উদ্যোগ-আয়োজন ছিল না। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান এ অঞ্চলের নেতা শেখ মুহিবুর রহমানের সাথে আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। আলোচনার নামে কথিত অগ্রগতির সংবাদ দিয়ে বিভ্রান্তির ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়। এ অবস্থায় একাত্তরের পঁচিশে মার্চ ‘কালো রাতে’ নিরীহ জনগোষ্ঠীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী। একাধারে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নিধন শুরু হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গ্রেফতার হন। এমন এক উদ্বেগাকুল পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬শে মার্চ তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের (পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট) স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা পেয়ে দিকভ্রান্ত জাতি মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। এভাবেই পরাজিত পাক বাহিনীর রাহু থেকে বাংলাদেশ পৃথক দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই করে নেয়।
এদিকে, রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা, অধিকার ও সম্মান নিশ্চিত করার দাবিতে মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি বাস্তবায়ন ও মুক্তিযোদ্ধা দিবস উদযাপন জাতীয় কমিটি আজ সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালন করবে। উল্লেখ্য, ২০০৪ সালে ১২ জানুয়ারি ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ থেকে প্রতি বছর ১ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আর ডিসেম্বর এলেই রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা রক্ষার দুর্জয় শপথের চেতনা শাণিত হয়। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটবে না- এমনটিই সকলের প্রত্যাশা।
লেখকঃ মুহম্মদ আলতাফ হোসেন
সভাপতি, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা।
সভাপতি, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা।