পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী তিন বছরের ডাক্তারি কোর্স আর সাত দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে পুলিশে নিয়োগ করার যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তাকে অবাস্তব এবং অবৈজ্ঞানিক বলছেন চিকিৎসক আর পুলিশ কর্মকর্তারা। মমতা ব্যানার্জী নার্সদেরও প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘সেমি’ ডাক্তার বানানো যায় কিনা, তাও ভেবে দেখতে বলেছেন।
মমতা ব্যানার্জীর কথায়, পশ্চিমবঙ্গের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের অভাব রয়েছে, তাই কম সময়ের কোর্স করিয়ে বা নার্সদের ‘সেমি’ ডাক্তার বানিয়ে কম জটিল রোগের চিকিৎসা এই ডিপ্লোমাধারী ডাক্তারদের দিয়ে করানো যায় কিনা, সেটা ভেবে দেখা দরকার।
এক প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেন, “লোকসংখ্যা বাড়ছে, হাসপাতাল বাড়ছে। ডাক্তারদের একটা ডিপ্লোমা কোর্স চালু করতে পারি কিনা দেখব, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো।’’
এদের মূলত গ্রামীণ সরকারি হাসপাতালগুলোতে কাজে লাগানো যেতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
আবার পুলিশে নিযুক্ত হওয়ার পরে যে ছয় মাসের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে, তাকে সাত দিনে নামিয়ে এনে তারপরেই থানায় পাঠানোর কথাও ভাবতে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
১৫ দিনের প্রশিক্ষণে নার্স থেকে ‘সেমি’ ডাক্তার
‘‘নার্সদের সংখ্যা কম থাকার জেরে সমস্যা হচ্ছে। নার্সিং কলেজ তৈরি করা হোক আরো। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগানো যেতে পারে। ১৫ দিনের প্রশিক্ষণই যথেষ্ট,” জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এও বলেন যে হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশন দিয়েই চলে যান, বাকি কাজটা করেন নার্সরাই। তাই তাদের প্রশিক্ষণ দিলে তারাও সাধারণ চিকিৎসাগুলো করতেই পারবেন, তবে এদের দিয়ে যে অপারেশন বা জটিল রোগের চিকিৎসা করানো হবে না, তাও জানিয়েছেন ব্যানার্জী।
চিকিৎসক এবং নার্সদের নিয়ে প্রস্তাব দেয়ার পরই রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব এনএস নিগমকে এই নিয়ে কমিটি তৈরি করার নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী।
কিন্তু কম সময়ের ডাক্তারি কোর্স বা নার্সদের পদোন্নতি দিয়ে ‘সেমি-ডাক্তার’ অথবার সাত দিনের প্রশিক্ষণে পুলিশ – এই সবগুলো প্রস্তাবেরই বিরোধিতা করছেন চিকিৎসক এবং পুলিশ মহল।
তারা এই প্রস্তাবগুলোকে অবাস্তব এবং অবৈজ্ঞানিক বলছেন।
‘একমাত্র স্বীকৃত ডাক্তারি কোর্স ৫ বছরের’
মমতা ব্যানার্জী মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ৫টি সরকারি এবং একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ছিল। সংখ্যাটা বেড়ে এখন হয়েছে ৩২। প্রায় সব জেলা হাসপাতালেকেই মেডিক্যাল কলেজ বানিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসকরা বলেন বেশিরভাগ কলেজে চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়ানোর পরিকাঠামো, যন্ত্রপাতি, শিক্ষকের অভাব আছে।
আবার বড় বড় ভবন তৈরি করে অনেক মাল্টি স্পেশালিটি হাসপাতাল গড়া হয়েছে, কিন্তু সেখানে রয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আর যন্ত্রপাতির অভাব।
পশ্চিমবঙ্গের সরকারি চিকিৎসকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টর্সের সম্পাদক ড. মানস গুমটা বলছিলেন, “তিন বছরের ডিপ্লোমা কোর্সের যে প্রস্তাব মুখ্যমন্ত্রী এনেছেন, তার বিরোধিতার দুটো দিক আছে। প্রথমত, ভারতের ডাক্তারি শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে যে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন, তাদের স্বীকৃত একমাত্র কোর্স হলো এমবিবিএস, যা পাঁচ বছরের কোর্স। মডার্ন মেডিসিনের কোনো কোর্স এনএমসির অনুমোদন ছাড়া চালু করা যায় না। দ্বিতীয়ত মুখ্যমন্ত্রী চিকিৎসকের অভাবের যে প্রসঙ্গ এনেছেন, সেটাও সঠিক নয়।
“আমাদের রাজ্যে ৩২টি মেডিক্যাল কলেজ আছে, যেখান থেকে প্রতিবছর ৪৮০০ জন ডাক্তার পাশ করে বেরোচ্ছেন। সমস্যাটা হচ্ছে তাদের নিয়োগ ঠিক ভাবে হয় না। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে যেমন ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা থাকে, ডাক্তারি পড়ুয়াদের জন্য সেসব হয় না। পাস করে বেরোনোর আগে ইন্টার্ন থাকার সময়েই যদি ডাক্তারেরা চাকরি পেয়ে যান, তাহলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমাদের রাজ্যে গত সাত বছরের কোনো দাঁতের শল্য চিকিৎসক নিযুক্ত হননি। গড়ে ২০০-৩০০ জন ডাক্তার নিযুক্ত হচ্ছেন এই রাজ্যে। তাই চিকিৎসকের অভাব নেই,” বলছিলেন ড. গুমটা।
তিনি বলছিলেন তিন বছরের ডিপ্লোমা করিয়ে গ্রামে পাঠালে সেটা মানুষের সাথে প্রতারণা করা হবে এবং রোগীদের জীবনের ঝুঁকিও তৈরি হবে।
৭ দিনে পুলিশ!
পুলিশে নিয়োগের বিষয়ে মমতা ব্যানার্জী স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন যে আগামী তিন মাসের মধ্যে রাজ্য পুলিশে সব নিয়োগ শেষ করতে হবে। তিনি জানিয়েছেন, “এত দিন ছয় মাস ধরে প্রশিক্ষণ দেয়া হত। এখন সাত দিন প্রশিক্ষণ দেয়ার পর তাদের থানায় পাঠান। সেখানে ফোর্স বাড়ান। মাসের মধ্যে ২১ দিন ফিল্ডে করানো হোক। সাত দিন অন্যান্য প্রশিক্ষণ দেয়া হোক।’’
অবসরপ্রাপ্ত একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা সাত দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে পুলিশে নিয়োগ নিয়ে কিছু বলতে চাননি। তবে একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ছয় মাসের প্রশিক্ষণের অনেকগুলো বিষয় থাকে, সেখানে আইন পড়তে হয়, শারীরিক সক্ষমতা শেখানো হয়, অস্ত্র চালনা, তদন্ত করা ইত্যাদি শেখানো হয়। সব কিছু সাত দিনের মধ্যে কিভাবে সম্ভব!”
তিনি নিজের প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলছিলেন, “আমাদের প্রতিদিন সকালে ১২ কিলোমিটার দৌড়াতে হত। গুলি চালনার প্রশিক্ষণ হত। কিভাবে আইন শৃঙ্খলা সামলাতে হবে, তা শেখানো হয়। এই সবগুলোই আমাদের কর্মজীবনে অত্যন্ত জরুরি। মাত্র সাতদিন প্রশিক্ষণ দিয়ে থানায় ডিউটি করতে পাঠিয়ে দেওয়া হলে একজন নতুন নিযুক্ত পুলিশ কর্মী তো কিছু না জেনেই আইনরক্ষক হয়ে যাবেন। তিনি কী সঠিকভাবে কাজ করতে পারবেন?” প্রশ্ন ওই অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার।
মুখ্যমন্ত্রী শুধু প্রস্তাব দিয়েছেন: তৃণমূল কংগ্রেস
ডিপ্লোমা কোর্স করে চিকিৎসক তৈরি বা নার্সদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘সেমি চিকিৎসক’ গড়ার প্রস্তাব নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থক প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসকরা মন্তব্য করতে চাননি। মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের এক মুখপাত্রও।
তবে দলটির অন্যতম মুখপাত্র অধ্যাপক মনোজিৎ মন্ডল বলছিলেন, “মুখ্যমন্ত্রী যেটা বলেছেন, সেটা যে প্রস্তাব, তা কিন্তু তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন। কমিটি হবে, বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া হবে। তিনি এটাও বলেছেন যে ডিপ্লোমা পাস করে যারা ডাক্তার হবেন, তারা অপারেশন বা কোনো জটিল রোগের চিকিৎসা করবেন না। তারা মূলত গ্রামের দিকে প্রাথমিক চিকিৎসা করবেন। সেখানে যে ডাক্তারের অভাব রয়েছে, তা তো সবারই জানা আছে।“
প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজার ডাক্তার পাশ করে বেরচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মেডিক্যাল কলেজগুলো থেকে বলে যে তথ্য চিকিৎসক সংগঠনগুলো দিচ্ছে, সেটাও সঠিক নয় বলে মন্তব্য অধ্যাপক মন্ডলের।
তিনি বলছিলেন, “সবাই কী আর সরকারি চাকরি করতে যাচ্ছে? তাহলে এই সংখ্যক ডাক্তার সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায় আসতে পারেন বলাটা তো ঠিক নয়। আর যত ডাক্তার পাস করে বেরুচ্ছেন, তাদের অর্ধেকও যদি সরকারি চাকরিতে আসতেন, তাহলেও সেটা অপ্রতুলই হত। আসলে আমরা গ্রামের মানুষের প্রয়োজনটাই শহরে বসে বুঝতে পারি না। সেখানে সামান্য সর্দি, জ্বর, পেট খারাপের ওষুধের জন্যও তাদের শহরের হাসপাতালে আসতে হয়। কিন্তু যদি তিন বছরের কোর্স করে সেই সামান্য রোগের চিকিৎসাটা গ্রামেই হয়ে যায়, তাহলে তো গ্রামের মানুষেরই সুবিধা হবে। তবে, এটা এখনো পরামর্শই, এখনই তো আর কিছু সিদ্ধান্ত হয়ে যায়নি।“
পুলিশে নিয়োগের জন্য সাত দিনের প্রশিক্ষণই যথেষ্ট কিনা, সেটা পুলিশের কর্মকর্তারা নিশ্চই মুখ্যমন্ত্রীকে সঠিক পরামর্শ দেবেন বলেই আশা করেন অধ্যাপক মন্ডল। সূত্র : বিবিসি