মো.হাসান আলীঃ ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আনুগত্য প্রত্যাখ্যান করে পাবনা জেলা প্রশাসক বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল কাদের খান ও পুলিশ সুপার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গাফ্ফার, আরআই আব্দুল খায়ের প্রতিরোধ যুদ্ধে একাত্বতা ঘোষণা করে গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রাখেন। এরফলে অনিবার্য হয়ে পড়ে প্রতিরোধ যুদ্ধের বিজয়। জেলার কর্মরত পুলিশ সদস্যরা পাবনার মুক্তিকামী জনতা এবং সশস্ত্র যোদ্ধাদের সাথে একাত্বতা ঘোষণা করে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ যুদ্ধে (পাবনা পুলিশ লাইন যুদ্ধ-২৭ মার্চ-১৯৭১) ২৯ জন পুলিশ সদস্য শহীদ হন। ২৬ মার্চ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত প্রতিরোধ যুদ্ধে জেলার ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ যুদ্ধে নিহত হয় ১৯০ জন পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য। ১৯৭১ সালে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে জেলা প্রশাসক বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল কাদের খান ও পুলিশ সুপার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গাফফার, আ্রআই আব্দুল খায়ের এবং পুলিশ সদস্যরা যে বীরত্বপূর্ণ ভ’মিকা রেখেছেন, তা পাবনাবাসীর কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে হয়ে থাকবে। প্রতিরোধ যুদ্ধে যে সকল পুলিশ সদস্য শহীদ হয়েছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন, এসআই হাবিবুর রহমান বেগ, এসআই মজিবুল হক, হাবিলদার-২০ ইসরাইল হক, কনস্টবল-১৯৭ শেখ রহিম উদ্দীন, কনস্টবল-২০৩ হুজ্জুত আলী, কনস্টবল-২৪০ মেনহাজ উদ্দীন, এসআই গিয়াস উদ্দীন প্রামানিক, এসআই মনতোন আলী, হাবিলদার-৬৪২ রজব আলী, কনস্টবল-৩৯৫ লাল খান, কনস্টবল-৭৭৮ ফয়েজ উদ্দীন, কনস্টবল-৮৬৮ আবুল কাশেম, কনস্টবল-২৪ শহিরুদ্দিন সরকার, এসআই আলী আজম ভুঁইয়া, এসআই তৌহিদ খান, হাবিলদার-১১১ সিরাজুল ইসলাম সিদ্দিক, কনস্টবল-২৬৯ হুসেন আলী, কনস্টবল-৩৭৭ মোসলেম উদ্দীন, কনস্টবল-৩৪৪ আব্দুস সামাদ, কনস্টবল-৩৮০ ইমান আলী মোল্লা, এসআই বিনয় রবূষণ সিংহ, এসআই আব্দুল জলিল, এসআই অনিল কুমার ঘোষ, নায়েক-১৪৬ আব্বাস আলী, কনস্টবল- ৫৭৭ এতিম আলী, কনস্টবল-৩৮৮ রেণু মিয়া, কনস্টবল-৮৫৫ রমজান আলী, কনস্টবল আবুল কাশেম (২) প্রমুখ শহীদ পুলিশ সদস্য। এদিকে পাবনায় সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের আগে ২৫ মার্চের পূর্বে থেকেই পাকিস্তনি ২৫ তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি মোতায়েন ছিল। এদের মূল অবস্থান ছিল শহরের পশ্চিমে বিসিক শিল্পনগরীর অভ্যন্তরে। শহরের উত্তর-পশ্চিমে ডাক বাংলা এবং নূরপুর ওয়াব্দা ভবনে। ২৫-২৬ মার্চ এই অবস্থায় পাবনায় অবস্থানরত পাকসেনাদের শক্তিবৃদ্ধির জন্য ২৫ মার্চ গভীর রাতে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত আরও দুইশত সেনা প্রবেশ করে। এরপর তারা পাবনায় গণহত্যা পরিচালনার জন্য পরিকল্পণা করে। পরিকল্পণার অংশ হিসেবে ২৭ মার্চ বিকেলে কার্ফু জারি করে পুলিশ লাইনের নিয়ন্ত্রণ দখলের জন্য অভিযান চালায়। পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল পাবনার ছাত্র-জনতা ও সাহসী যোদ্ধারা। এর আগে ২৬ মার্চ সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সহযোগীতা ও আনুগত্য কামনা করে ম্যাসেজ পাঠায় পাকসেনারা। কিন্তু জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান ও পুলিশ সুপার আব্দুল গাফ্ফার এ আহবান প্রত্যাখ্যান করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান ঘোষণা করেন। এই পেক্ষাপটে পাবনার মুক্তিকামী যোদ্ধাদের জন্য পুলিশ লাইনের ম্যাগাজিন ঘর খুলে দিয়ে অস্ত্র বিতরণ করা হয়। ফলে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্রযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। এর আগেই আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ হোসেন এমএনএ, আব্দুর রব বগা মিয়া, আমিনুল ইসলাম বাদশা, জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান, পুলিশ সুপার আব্দুল গাফ্ফার, আরআই আবুল খায়ের প্রমুখ আত্মরক্ষা ও প্রতিরোধ যুদ্ধের পরিকল্পণা গ্রহণ করে রেখেছিলেন। পাকসেনারা পুলিশ লাইনের কাছাকাছি এসে হ্যান্ডমাইক যোগে পুলিশ বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহবান জানালে, পাল্টা জবাবে জানিয়ে দেয়া হয়, পাকসেনারা অগ্রসর হলে পুলিশ বাহিনী তাদের ওপর গুলি চালাতে বাধ্য হবে। এর উত্তরে পাকসেনারা কয়েক দফা মেশিনগানের গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ লাইন এবং আশপাশের অবস্থান নেওয়া পুলিশ সদস্য ও সশস্ত্র যোদ্ধারা গুলি চালায়। এরপর ২৮ মার্চ পাবনা টেলিফোন ভবন, লস্করপুর, ২৭-২৯ মার্চ বিসিক শিল্পনগরী, রেস্ট হাউজ, বালিয়াহলট, মালিগাছা এবং বিভিন্ন স্থানসহ জেলার প্রতিটি থানায় ছড়িয়ে পড়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে মেজর আসলামসহ ১৯০ জন পাকসেনা নিহত হয়। কাকী সেনারা বিভিন্ন স্থানে খন্ড-খন্ড যুদ্ধে নিহত হয় এবং শত্রæমুক্ত হয় পাবনা। আর এ যুদ্ধে শহীদ হন ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা। আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাকসেনাদের বিরুদ্ধে তীর-ধনুক, লাঠি-শোটা, দা-কুড়াল, ফালা-বল্লম, ঢাল-তলোয়ার, গাদা বন্দুক, টুটুবোর রাইফেলসহ সাধারণ অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা এবং মুক্তিযোদ্ধারা। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা তাদের সয়ংক্রিয় রাইফেল নিয়ে যুদ্ধে অংশ নেন। এ যুদ্ধে পাকসেনাদের কাছ থেকে উদ্ধর করা অস্ত্র তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। (তথ্যসুত্র: রবিউল ইসলাম রবি: ‘পাবনা ১৯৭১’)।
মো.হাসান আলী
সাংবাদিক/কলামিস্ট
পাবনা।