ভূমিকা
মানবাধিকারের অন্তর্নিহিত বিষয় হচ্ছে ‘মানুষ’ ও ‘অধিকার’। শব্দ দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও
তাৎপর্যমন্ডিত। সহজভাবে ‘মানবাধিকার’ বলতে আমরা সেই সব অধিকারকে বুঝি যা নিয়ে মানুষ
জন্মগ্রহণ করে এবং যা তাকে পরিপূর্ণ মানুষে বিকশিত করতে সাহায্য করে এবং যা হরণ করলে মানুষ
আর মানুষ থাকে না। মানুষ হিসেবে জন্মেছে বলেই এসব অধিকারও সে সাথেই নিয়ে এসেছে ও তার পাওনা হয়েছে। মানুষ
সৃষ্টির সেরা জীব। আর মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে উঠতে দরকার মানবাধিকার। মানবাধিকার ছাড়া মানুষের
পূর্ণতা আসে না, মানুষ পরিপূর্ণরূপে মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। মানুষের জীবন-মৃত্যু যেমন মানুষ
থেকে অবিচ্ছেদ্য তেমনি তার জন্যে তার মৌলিক অধিকার গুলোও অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য। সারা বিশ্বে এখন গড়ে উঠছে
মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা, মানবাধিকার সংক্ষরণকারী প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন কমিশন ও কমিটি। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী ও
রাষ্ট্র মানবাধিকারের বিষয়ে এখন সদা সচেতন। তাই যখন মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় তখন বিশ্ব বিবেক এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে। ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক, গবেষক, বিচারক, সরকার তথা সর্বস্তরের মানুষের জন্যই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রের প্রস্তাবনা
Premble of the Universal Declaration of Human Rights
সূচনা
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ তার সিদ্ধান্ত নং ২১৭ এ (১১১) দ্বারা
বিশ্বজনীন মানবাধিকারসমূহ গ্রহণ ও ঘোষণা করে। এ ঘোষণাপত্রের শিরোনাম হচ্ছে,“বিশ্বজনীন
মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র” (Universal Declaration of Human Rights)।কেন
মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র জারি করা হল, কি এর উদ্দেশ্য, এর প্রয়োজনীয়তাই বা কতটুকু সে
বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে প্রস্তাবনায়। প্রস্তাবনায় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়েছে এ ঘোষণার যৌক্তিকতা।
বিশ্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন করার জন্যে এ প্রস্তাবনার
অবতারণা করা হয়েছে। এ কারণেই বিশ্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা
পেতে হলে আমাদের এর প্রস্তাবনা যথার্থভাবেই বুঝতে হবে।
জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত মৌলিক মানবাধিকারসমূহ (ঘোষণাপত্র, ১৯৪৮)
মানবাধিকার ঘোষণা দলিলের মোট অনুচ্ছেদ সংখ্যা ৩০। বিশ্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রে
৩০টি অনুচ্ছেদে মানুষের যে সকল অধিকারের কথা বলা হয়েছে সেগুলো বিশ্লেষণ করলে যেসকল
অধিকার পাওয়া যায় তা নিম্নরুপঃ
অনুচ্ছেদ ১
সমস্ত মানুষ স্বাধীনভাবে সমান মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তাঁদের বিবেক এবং বুদ্ধি আছে; সুতরাং সকলেরই একে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্বসুলভ মনোভাব নিয়ে আচরণ করা উচিৎ।
অনুচ্ছেদ ২
এ ঘোষণায় উল্লেখিত স্বাধীনতা এবং অধিকারসমূহে গোত্র, ধর্ম, বর্ণ, শিক্ষা, ভাষা, রাজনৈতিক বা অন্যবিধ মতামত, জাতীয় বা সামাজিক উত্পত্তি, জন্ম, সম্পত্তি বা অন্য কোন মর্যাদা নির্বিশেষে প্রত্যেকেরই সমান অধিকার থাকবে।
কোন দেশ বা ভূখণ্ডের রাজনৈতিক, সীমানাগত বা আন্তর্জাতিক মর্যাদার ভিত্তিতে তার কোন অধিবাসীর প্রতি কোনরূপ বৈষম্য করা হবেনা; সে দেশ বা ভূখণ্ড স্বাধীনই হোক, হোক অছিভূক্ত, অস্বায়ত্বশাসিত কিংবা সার্বভৌমত্বের অন্য কোন সীমাবদ্ধতায় বিরাজমান।
অনুচ্ছেদ ৩
জীবন, স্বাধীনতা এবং দৈহিক নিরাপত্তায় প্রত্যেকের অধিকার আছে।
অনুচ্ছেদ ৪
কাউকে অধীনতা বা দাসত্বে আবদ্ধ করা যাবে না। সকল প্রকার ক্রীতদাস প্রথা এবং দাসব্যবসা নিষিদ্ধ করা হবে।
অনুচ্ছেদ ৫
কাউকে নির্যাতন করা যাবে না; কিংবা কারো প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ করা যাবে না অথবা কাউকে এহেন শাস্তি দেওয়া যাবে না।
অনুচ্ছেদ ৬
আইনের সামনে প্রত্যেকেরই ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভের অধিকার আছে।
অনুচ্ছেদ ৭
আইনের চোখে সবাই সমান এবং ব্যক্তিনির্বিশেষে সকলেই আইনের আশ্রয় সমানভাবে ভোগ করবে। এই ঘোষণা লঙ্ঘন করে এমন কোন বৈষম্য বা বৈষম্য সৃষ্টির প্ররোচনার মুখে সমান ভাবে আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই আছে।
অনুচ্ছেদ ৮
শাসনতন্ত্রে বা আইনে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে উপযুক্ত জাতীয় বিচার আদালতের কাছ থেকে কার্যকর প্রতিকার লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
অনুচ্ছেদ ৯
কাউকেই খেয়ালখুশীমত গ্রেপ্তার বা অন্তরীণ করা কিংবা নির্বাসন দেওয়া যাবে না।
অনুচ্ছেদ ১০
নিজের অধিকার ও দায়িত্ব নির্ধারণ এবং নিজের বিরুদ্ধে আনীত ফৌজদারী অভিযোগ নিরূপণের জন্য প্রত্যেকেরই পূর্ণ সমতার ভিত্তিতে একটি স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ বিচার-আদালতে প্রকাশ্য শুনানি লাভের অধিকার রয়েছে।
অনুচ্ছেদ ১১
১. দণ্ডযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের নিশ্চিত অধিকারসম্বলিত একটি প্রকাশ্য আদালতে আইনানুসারে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ গণ্য হওয়ার অধিকার থাকবে।
২. কাউকেই এমন কোন কাজ বা ত্রুটির জন্য দণ্ডযোগ্য অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না, যে কাজ বা ত্রুটি সংঘটনের সময় জাতীয় বা আন্তর্জাতিক আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ ছিলনা। দণ্ডযোগ্য অপরাধ সংঘটনের সময় যে শাস্তি প্রযোজ্য ছিল, তার চেয়ে গুরুতর শাস্তিও দেওয়া চলবে না।
অনুচ্ছেদ ১২
কারো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কিংবা তাঁর গৃহ, পরিবার ও চিঠিপত্রের ব্যাপারে খেয়ালখুশীমত হস্তক্ষেপ কিংবা তাঁর সুনাম ও সম্মানের উপর আঘাত করা চলবে না। এ ধরনের হস্তক্ষেপ বা আঘাতের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
অনুচ্ছেদ ১৩
১. নিজ রাষ্ট্রের চৌহদ্দির মধ্যে স্বাধীনভাবে চলাফেরা এবং বসবাস করার অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
২. প্রত্যেকেরই নিজ দেশ সহ যে কোন দেশ পরিত্যাগ এবং স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের অধিকার রয়েছে।
অনুচ্ছেদ ১৪
১. নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভিন্নদেশে আশ্রয় প্রার্থনা করবার এবং সে দেশের আশ্রয়ে থাকবার অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
২. অরাজনৈতিক অপরাধ এবং জাতিসংঘের উদ্দেশ্য এবং মূলনীতির পরিপন্থী কাজ থেকে সত্যিকারভাবে উদ্ভূত অভিযোগের ক্ষেত্রে এ অধিকার প্রার্থনা নাও করা যেতে পারে।
অনুচ্ছেদ ১৫
১. প্রত্যেকেরই একটি জাতীয়তার অধিকার রয়েছে।
২. কাউকেই যথেচ্ছভাবে তাঁর জাতীয়তা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না, কিংবা কারো জাতীয়তা পরিবর্তনের অধিকার অগ্রাহ্য করা যাবে না।
অনুচ্ছেদ ১৬
১. ধর্ম, গোত্র ও জাতি নির্বিশেষে সকল পূর্ণ বয়স্ক নরনারীর বিয়ে করা এবং পরিবার প্রতিষ্ঠার অধিকার রয়েছে। বিয়ে, দাম্পত্যজীবন এবং বিবাহবিচ্ছেদে তাঁদের সমান অধিকার থাকবে।
২. বিয়েতে ইচ্ছুক নরনারীর স্বাধীন এবং পূর্ণ সম্মতিতেই কেবল বিয়ে সম্পন্ন হবে।
৩. পরিবার হচ্ছে সমাজের স্বাভাবিক এবং মৌলিক গোষ্ঠী-একক, সুতরাং সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিরাপত্তা লাভের অধিকার পরিবারের রয়েছে।
অনুচ্ছেদ ১৭
১. প্রত্যেকেরই একা অথবা অন্যের সঙ্গে মিলিতভাবে সম্পত্তির মালিক হওয়ার অধিকার আছে।
২. কাউকেই যথেচ্ছভাবে তাঁর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
অনুচ্ছেদ ১৮
প্রত্যেকেরই ধর্ম, বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতায় অধিকার রয়েছে। এ অধিকারের সঙ্গে ধর্ম বা বিশ্বাস পরিবর্তনের অধিকার এবং এই সঙ্গে, প্রকাশ্যে বা একান্তে, একা বা অন্যের সঙ্গে মিলিতভাবে, শিক্ষাদান, অনুশীলন, উপাসনা বা আচারব্রত পালনের মাধ্যমে ধর্ম বা বিশ্বাস ব্যক্ত করার অধিকারও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
অনুচ্ছেদ ১৯
প্রত্যেকেরই মতামত পোষণ এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতায় অধিকার রয়েছে। অবাধে মতামত পোষণ এবং রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে যে কোন মাধ্যমের মারফত ভাব এবং তথ্য জ্ঞাপন, গ্রহণ ও সন্ধানের স্বাধীনতাও এ অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।
অনুচ্ছেদ ২০
১. প্রত্যেকেরই শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশগ্রহণ ও সমিতি গঠনের স্বাধীনতায় অধিকার রয়েছে।
২. কাউকে কোন সংঘভূক্ত হতে বাধ্য করা যাবে না।
অনুচ্ছেদ ২১
১. প্রত্যক্ষভাবে বা অবাধে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিজ দেশের শাসন পরিচালনায় অংশগ্রহণের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
২. নিজ দেশের সরকারী চাকুরীতে সমান সুযোগ লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
৩. জনগণের ইচ্ছাই হবে সরকারের শাসন ক্ষমতার ভিত্তি; এই ইচ্ছা নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত প্রকৃত নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যক্ত হবে; গোপন ব্যালট কিংবা সমপর্যায়ের কোন অবাধ ভোটদান পদ্ধতিতে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
অনুচ্ছেদ ২২
সমাজের সদস্য হিসেবে প্রত্যেকেরই সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার আছে। জাতীয় প্রচেষ্টা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সংগঠন ও সম্পদের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রত্যেকেরই আপন মর্যাদা এবং ব্যক্তিত্বের অবাধ বিকাশের জন্য অপরিহার্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারসমূহ আদায়ের অধিকার রয়েছে।
অনুচ্ছেদ ২৩
১. প্রত্যেকেরই কাজ করার, স্বাধীনভাবে চাকুরী বেছে নেবার, কাজের ন্যায্য এবং অনুকূল পরিবেশ লাভ করার এবং বেকারত্ব থেকে রক্ষিত হবার অধিকার রয়েছে।
২. কোনরূপ বৈষম্য ছাড়া সমান কাজের জন্য সমান বেতন পাবার অধিকার প্রত্যেকেরই আছে।
৩. কাজ করেন এমন প্রত্যেকেরই নিজের এবং পরিবারের মানবিক মর্যাদার সমতুল্য অস্তিত্বের নিশ্চয়তা দিতে পারে এমন ন্যায্য ও অনুকূল পারিশ্রমিক লাভের অধিকার রয়েছে; প্রয়োজনবোধে একে অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাদি দ্বারা পরিবর্ধিত করা যেতে পারে।
৪. নিজ স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য প্রত্যেকেরই ট্রেড ইউনিয়ন গঠন এবং তাতে যোগদানের অধিকার রয়েছে।
অনুচ্ছেদ ২৪
প্রত্যেকেরই বিশ্রাম ও অবসরের অধিকার রয়েছে; নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে বেতনসহ ছুটি এবং পেশাগত কাজের যুক্তিসঙ্গত সীমাও এ অধিকারের অন্তর্ভূক্ত।
অনুচ্ছেদ ২৫
১. খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিত্সা ও প্রয়োজনীয় সমাজ কল্যাণমূলক কার্যাদির সুযোগ এবং এ সঙ্গে পীড়া, অক্ষমতা, বৈধব্য, বার্ধক্য অথবা জীবনযাপনে অনিবার্যকারণে সংঘটিত অন্যান্য অপারগতার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং বেকার হলে নিরাপত্তার অধিকার সহ নিজের এবং নিজ পরিবারের স্বাস্থ্য এবং কল্যাণের জন্য পর্যাপ্ত জীবনমানের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
২. মাতৃত্ব এবং শৈশবাবস্থায় প্রতিটি নারী এবং শিশুর বিশেষ যত্ন এবং সাহায্য লাভের অধিকার আছে। বিবাহবন্ধন-বহির্ভূত কিংবা বিবাহবন্ধনজাত সকল শিশু অভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা ভোগ করবে।
অনুচ্ছেদ ২৬
১. প্রত্যেকেরই শিক্ষালাভের অধিকার রয়েছে। অন্ততঃপক্ষে প্রাথমিক ও মৌলিক পর্যায়ে শিক্ষা অবৈতনিক হবে। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে। কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সাধারণভাবে লভ্য থাকবে এবং উচ্চতর শিক্ষা মেধার ভিত্তিতে সকলের জন্য সমভাবে উন্মুক্ত থাকবে।
২. ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ এবং মানবিক অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা-সমূহের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে শিক্ষা পরিচালিত হবে। শিক্ষা সকল জাতি, গোত্র এবং ধর্মের মধ্যে সমঝোতা, সহিষ্ণুতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়াস পাবে এবং শান্তিরক্ষার স্বার্থে জাতিসংঘের কার্যাবলীকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
৩. কোন ধরনের শিক্ষা সন্তানকে দেওয়া হবে, তা বেছে নেবার পূর্বাধিকার পিতামাতার থাকবে।
অনুচ্ছেদ ২৭
১. প্রত্যেকেরই সমষ্টিগত সাংস্কৃতিক জীবনে অংশগ্রহণ করা, শিল্পকলা উপভোগ করা এবং বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও তার সুফল সমূহে অংশীদার হওয়ার অধিকার রয়েছে।
২. বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পকলা ভিত্তিক কোন কর্মের রচয়িতা হিসেবে নৈতিক ও বৈষয়িক স্বার্থ সংরক্ষণের অধিকার প্রত্যেকেরই থাকবে।
অনুচ্ছেদ ২৮
এ ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহের বাস্তবায়ন সম্ভব এমন একটি সামাজিক ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় অংশীদারীত্বের অধিকার প্রত্যেকেরই আছে।
অনুচ্ছেদ ২৯
১. প্রত্যেকেরই সে সমাজের প্রতি পালনীয় কর্তব্য রয়েছে, যে সমাজেই কেবল তাঁর আপন ব্যক্তিত্বের স্বাধীন এবং পূর্ণ বিকাশ সম্ভব।
২. আপন স্বাধীনতা এবং অধিকারসমূহ ভোগ করার সময় প্রত্যেকেই কেবলমাত্র ঐ ধরনের সীমাবদ্ধতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন যা অন্যদের অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহ নিশ্চিত করা এবং একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নৈতিকতা, গণশৃংখলা ও সাধারণ কল্যাণের ন্যায়ানুগ প্রয়োজন মেটাবার জন্য আইন দ্বারা নির্ণীত হবে।
৩. জাতিসংঘের উদ্দেশ্য ও মূলনীতির পরিপন্থী কোন উপায়ে এ অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহ ভোগ করা যাবে না।
অনুচ্ছেদ ৩০
কোন রাষ্ট্র, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি এ ঘোষণাপত্রের কোন কিছুকেই এমনভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবেন না, যার বলে তারা এই ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহ ধ্বংস করতে পারে; এমন কোন কাজে লিপ্ত হতে পারেন; কিংবা সে ধরনের কোন কাজ সম্পাদন করতে পারেন।
Source: The Universal Declaration of Human Rights (UDHR)
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট সংস্থা
মানবধিকার কমিশনই হচ্ছে মানবাধিকার সম্পর্কিত জাতিসংঘের প্রধান সংস্থা। মানবাধিকার বিষয়ে এ
কমিশনই সার্বিক নীতি নির্দেশনা দিয়ে থাকে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের একটি সংস্থা হিসেবে
১৯৪৬ সালে কমিশনটি গঠিত হয়। ৪৩ সদস্যের এ কমিশন মানবাধিকার সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে
বিভিন্ন সুপারিশের উদ্দেশ্যে প্রতি বছর ছয় সপ্তাহকাল অধিবেশনে বসে। কমিশন তার ব্যাপক
ক্ষমতাবলে মানবাধিকার সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম। মানবাধিকার এবং
বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি কিংবা মানবাধিকার উন্নয়নের মত বিভিন্ন মৌলিক প্রশ্নে কমিশন
সমীক্ষা চালিয়ে থাকে। এ সংস্থা নতুন আন্তর্জাতিক চুক্তিও প্রণয়ন করে। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন
অঞ্চলে মানবাধিকার সংরক্ষিত হচ্ছে কিনা, তা তদন্ত করে দেখাও কমিশনের দায়িত্ব। ব্যাপকহারে
মানবাধিকার লংঘনের প্রতিকার বিধানে সরাসরি ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতাও কমিশনের রয়েছে।
১৯৪৭ সালে অনুষ্ঠিত কমিশনের প্রথম অধিবেশনে সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ রোধ ও
তাদের নিরাপত্তা বিধানের ব্যাপারে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি উপকমিশন প্রতিষ্ঠা করে।
বৈষম্যের অবসান এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সমীক্ষা
পরিচালনা ও সুপারিশ প্রদানই এই উপ-কমিশনের মূল লক্ষ্য। এ ছাড়াও পরিষদ বা কমিশনের প্রদত্ত
অন্যান্য দায়িত্বও সম্পাদন করতে হয় উপকমিশনকে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রধানত মানবাধিকার
লংঘনের বিষয়ে পেশকৃত অভিযোগপত্র পরীক্ষা ও পর্যালোচনা।
মানব তৎপরতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় জাতিসংঘের প্রায় সব কটি সংস্থাই কোন না কোনভাবে
মানবাধিকারের সঙ্গে জড়িত। মানবধিকার কমিশন ও তার উপকমিশন ছাড়া অপর যে সকল প্রধান
প্রধান ফোরামে মানবাধিকার প্রশ্ন আলোচনা করা হয়, সেগুলো হচ্ছে: সাধারণ পরিষদ, অর্থনৈতিক ও
সামাজিক পরিষদ, নারীদের মর্যাদাবিষয়ক কমিশন এবং বর্ণবৈষম্য দূরীকরণ কমিটি। এ সকল ফোরাম
বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার কার্যকরী করার অনুকূল সামাজিক ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ গড়ে তুলতে
প্রয়াসী। জাতিসংঘ সনদে সাধারণ পরিষদকে, “অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ এবং জাতি, ধর্ম, ভাষা, নারী পুরুষ নির্বিশেষে মানবাধিকার ও
মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করণে সাহায্য” করার উদ্দেশ্যে “সমীক্ষণ পরিচালনার নির্দেশ ও সুপারিশ
প্রদান” করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের উদ্যোগে
সাধারণ পরিষদের আলোচ্যসূচিতে মানবাধিকারের বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
জাতিসংঘ সনদ অনুসারে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ “সকলের জন্যে মৌলিক স্বাধীনতা ও
মানবাধিকার নিশ্চিত করা এবং এ ব্যাপারে মানুষের শ্রদ্ধাবোধ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে সুপারিশ” প্রদান
করতে পারে। মানবাধিকার সমুন্নত করার লক্ষ্যে সাধারণ পরিষদে প্রেরণের জন্যে খসড়া কনভেনশন
প্রণয়ন, আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান ও কমিশন গঠনের এখতিয়ারও পরিষদের রয়েছে। পরিষদ
এসকল বিষয়ে তার সুপারিশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত হবার জন্যে
জাতিসংঘের সদস্য দেশ ও জাতিসংঘের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমঝোতায় আসতে পারে।
জাতিসংঘের অন্যান্য প্রধান অঙ্গসংস্থা, নিরাপত্তা পরিষদ, অছি পরিষদ এবং আন্তর্জাতিক আদালতেও
মাঝে মাঝে মানবাধিকার প্রসঙ্গ গৃহীত হয়ে থাকে।
মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপারে জাতিসংঘের পদক্ষেপ
মানবাধিকার কমিশন ও তার উপ-কমিশন প্রতিবছর প্রকাশ্য অধিবেশনে মানবাধিকার ও মৌলিক
স্বাধীনতা লংঘনের প্রশ্নে আলোচনা করে থাকে। বিশ্বের যে কোন অংশে বর্ণবৈষম্য ও বর্ণবাদের
বিষয়বস্তু এ আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। পরিস্থিতির পর্যালোচনার আলোকে সংশ্লিষ্ট এলাকায় তথ্য সন্ধানীদল বা বিশেষজ্ঞ প্রেরণ, সরেজমিনে ঘটনাপ্রবাহ জরিপ, সরকারসমূহের সঙ্গে আলোচনা, প্রয়োজনীয়
সহায়তা দান, অথবা কোন কোন ক্ষেত্রে সরাসরি নিন্দা জ্ঞাপন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদক্ষেপ নেয়া
হয়।
এ ছাড়াও মানবাধিকার কমিশন ও তার উপ-কমিশন বিশেষত ব্যাপকহারে মানবাধিকার লংঘনের
কার্যকারণ পরীক্ষা করে দেখেছে। এ উদ্দেশ্যে দুটি কার্যনির্বাহী গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। একটির
দায়িত্ব হচ্ছে, দাসত্ব বা শিশু শ্রমের মতো অমানবিক আচরণ পর্যালোচনা। অপরটি বলপ্রয়োগের দরুন
বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিরুদ্দেশ হবার ঘটনাবলী তদন্তের উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়। নির্যাতনের ঘটনাও
অনুরূপ একটি উদ্বেগজনক বিষয়। অপরদিকে, ব্যাপকহারে দেশত্যাগ এবং সংক্ষিপ্ত ও একতরফা
বিচারে মৃত্যুদন্ড দানের বিষয় তদন্তের জন্যেও বিশেষ প্রতিবেদক নিয়োগ করা হয়েছে।
মানবাধিকার কার্যকর করতে জাতিসংঘের প্রয়াস
‘পরবর্তী প্রজন্মগুলোকে যুদ্ধের অভিশাপ থেকে রক্ষা করতে হবে’-এ মৌল অভিপ্রায় নিয়ে জাতিসংঘের
স্থপতিগণ ১৯৪৫ সালে এর সনদ প্রণয়ন করেছিলেন। এ সনদেই মৌলিক মানবাধিকার এবং ব্যক্তি
মানুষের মূল্য ও মর্যাদার বিষয়ে নেতৃবৃন্দের আস্থা এবং দৃঢ়তা অভিব্যক্ত হয়। জাতিসংঘের সনদেই
মূলত মানবাধিকারের প্রতিফলন ঘটে। সনদে বলা হয় যে, বিশ্বশান্তির জন্যে স্থিতিশীলতা ও
জনকল্যাণ অপরিহার্য। এ কারণেই জীবনযাত্রার উন্নততর মান নিশ্চিতকরণ, পূর্ণ কর্মসংস্থান,
আর্থসামাজিক অগ্রগতির পরিবেশ সৃষ্টি এবং জাতি, ধর্ম, ভাষা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানবাধিকারের
প্রতি সার্বজনীন শ্রদ্ধা ও সকল মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার বিষয়টি বিশ্বসংস্থার অন্যতম
অভীষ্ট লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।
মানবাধিকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং বিশ্বশান্তির মত বিষয়গুলো পরস্পরের সাথে
ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ছোটবড় নির্বিশেষে সকল দেশ ও জাতিকে এগুলো অর্জনে সহায়তার জন্যে
জাতিসংঘ তাই অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে মানবাধিকার বিষয়ক বিশ্বজনীন ঘোষণাপত্রটি প্রণয়ন
করে। ১৯৪৮ সালে সংস্থার সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে এ ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। এর আঠার
বছর পর ১৯৬৬ সালের ৬ ডিসেম্বর অর্থনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সম্পর্কে আন্তর্জাতিক
চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে ঘোষণাপত্রকে আরো সুনির্দিষ্ট আইনগত রূপ দেয়া হয়। এ সময় শেষোক্ত
চুক্তিটির একটি ঐচ্ছিক সহদলিলও গৃহীত হয়। এ দু’টি চুক্তি এবং ঐচ্ছিক সহদলিলটি যারা গ্রহণ
করেন, সে সকল দেশ থেকে মানবাধিকার কমিটি নামক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ কমিটিতে মানবাধিকার
লঙ্ঘনের বিষয়ে ব্যক্তিগত অভিযোগপত্র দাখিল করা যাবে। বস্তুত শুরু থেকে মানবাধিকার সমুন্নত
রাখার জন্যে বিশ্বসংস্থার জোর প্রয়াস চলছে। এর বিভিন্ন অঙ্গসংস্থা বিভিন্ন কনভেনশন গ্রহণ করেছে।
জাতিসংঘ তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের সহায়তায় বিশেষ বিষয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশন গ্রহণ
করেছে। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের বিভিন্ন অনুচ্ছেদকে আরো সুনির্দিষ্ট এবং তাৎপর্যপূর্ণ
করার জন্যে এ প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করা হয়। মানবাধিকার রক্ষার জন্যেই এসকল প্রস্তাব গ্রহণ ও বলবৎ
করা হয়।