# মুহম্মদ আলতাফ হোসেন #
অপরাধকে সভ্যতার অবদান বলা হয়। যখন সভ্যতা ছিল না তখন কোন কাজকে অপরাধ মনে করা হতো না। সব কিছুই চলতো ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে। কিন্তু সভ্যতার বিকাশ সাধনের সাথে সাথে মানুষের দৈনন্দিন ক্রিয়া-কর্মকে শ্রেণী বিন্যাস করে অপরাধের সংজ্ঞায়ন করা হলো। সাব্যস্ত হলো যা করা অনুচিত তা করাই অপরাধ এবং যা করা উচিত তা না করাও অপরাধ। আর এ অপরাধের প্রতিবিধান করার জন্য প্রণীত হলো দন্ডবিধি। আর এ দন্ডবিধি বাস্তবায়নের জন্যই স্থাপিত হলো বিচারালয়। তাই সংক্ষিপ্ত কথায় বিচার বিভাগের দায়িত্ব ও কর্তব্য খুবই পরিষ্কার।
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই শাসনতন্ত্র আছে। সে শাসনতন্ত্র অনুসরণ করেই সে দেশের শাসন কাজ ও রাষ্ট্রীয় তৎপরতা আবর্তিত হয়। মূলত শাসনতন্ত্র হচ্ছে রাষ্ট্রের অন্যতম দলিল। বিচার বিভাগ হচ্ছে রাষ্ট্রের অন্যতম অঙ্গ। বিচার বিভাগের মাধ্যমেই দেশে আইনের শাসন নিশ্চিত করে অপরাধীর শাস্তি বিধান করা হয়। রাষ্ট্রের বা কোন নাগরিকের কোন কার্যকলাপে অপর কোন নাগরিক সংক্ষুব্ধ হলে তিনি তার অধিকার নিশ্চিত করে অনধিকারকারীর শাস্তি বিধানের জন্য বিচার বিভাগের সাহায্য গ্রহণ করতে পারেন। এটা ব্যক্তির নাগরিক ও সাংবিধানিক অধিকার। তাকে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কোন সুযোগ নেই। মূলত আদালত হচ্ছে শাসনতন্ত্রের রক্ষক, সংবিধানের ব্যাখ্যা দাতা। দেশের শাসনতন্ত্র তথা সংবিধান অনুযায়ী কোন ব্যক্তির অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার মাধ্যমে প্রতিকার লাভ করতে পারেন। এটি সকল নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। আর আদালতের কাজ হলো নাগরিক তার সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে কী-না তা দেখা এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নাগরিকের অধিকার বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান করা। সে দিক নির্দেশনা বাস্তবায়নের পুরো দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের।
দেশের বিচার বিভাগ হচ্ছে সকল শ্রেণীর নাগরিকের শেষ ভরসাস্থল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যেহেতু রাজনৈতিক শক্তি নিয়ন্ত্রণ করে, তাই ক্ষেত্র বিশেষে নাগরিক রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণেই রাষ্ট্র কর্তৃক বৈষম্যের শিকার হন। সে ক্ষেত্রে আদালতই শেষ আশ্রয় ও ভরসাস্থল। কারণ, আদালত সকল প্রকার দলীয় দৃষ্টিভংগী ও রাজনৈতিক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। তাই নাগরিক কোন কারণে সংক্ষুব্ধ হলে প্রতিকার লাভের জন্য আদালতের আশ্রয় নেয় এবং আদালত দেশের শাসনতন্ত্র তথা সংবিধান ও প্রচলিত আইন অনুসরণ করেই সম্পর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভংগীর ঊর্ধ্বে থেকে নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। আর এ নির্দেশনা দেশের সকল শ্রেণীর নাগরিকসহ রাষ্ট্রও মেনে চলতে বাধ্য হয়। যদি কোন রাষ্ট্রে এ অবস্থার ব্যত্যয় ঘটে তাহলে সে রাষ্ট্র সফল রাষ্ট্র বলার কোন সুযোগ নেই বরং সেদেশের মানুষ সব সময়ই নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন।
এবার বিচারকদের বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। বিচারকরাও মানুষ। তারা কখনোই মানবীয় ভুল-ত্রুটির উর্দ্ধে নন। তাদেরও রাজনৈতিক দৃষ্টিভংগী আছে, আছে মানবিক দুর্বলতা। যেহেতু তাদের ভোটাধিকার আছে, তাই তাদের রাজনৈতিক অধিকার অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু কোন ব্যক্তি যখন বিচারকের আসন অলংকৃত করবেন,তখন তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভংগী লুপ্ত না হলেও সুপ্ত হবে। একজন বিচারককে প্রবল ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে তার ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি ও অনুরাগ-বিরাগের উপর পুরোদস্তুর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে ন্যায়-ইনসাফের ভিত্তিত্তে সম্পর্ণ নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করবেন। কোন বিচারক যদি তার মানবীয় দুর্বলতা, কারো প্রতি অনুরাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠতে না পারেন,তাহলে তিনি যথেষ্ট যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিচারক হওয়ার যোগ্য হবেন না।
আমাদের দেশের বিরোধী দল শুধুমাত্র বিরোধিতার খাতিরেই বিরোধিতা করে বলেই জনশ্রুতি আছে। তারা সরকারের কোন কাজের ভাল-মন্দের বাছ-বিচার না করেই চোখ বন্ধ করে সরকারী সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। সে যাই হোক আমাদের দেশের বিরোধীদলগুলোর সর্বসাম্প্রতিক বক্তব্যে একথা সুস্পষ্ট যে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে উচ্চতর আদালত পর্যন্ত দলীয়করণ করে দেশের বিচারালয়গুলোকে দলীয় কার্যালয়ে পরিণত করেছে। দলীয় বিবেচনায় দেশের উচ্চ আদালতে বিচারক হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে হত্যা মামলা ও প্রধান বিচারপতির এজলাস ভাংচুরের অভিযোগে অভিযুক্তকে। আওয়ামী লীগ বিগত মেয়াদে একজন ফাঁসির আসামীকেও হাইকোর্টের বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দিয়েছিল। বিরোধী দলীয় দাবী অনুযায়ী সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে মেধা, সততা, যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতার বাছ-বিচার না করেই দলীয় ক্যাডারদের দেশের আদালতগুলোতে বিচারক হিসাবে নিয়োগ দিয়ে সরকার আদালতের মাধ্যমেই দলীয় ও রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। এ ব্যাপারে বেশ হাটে হাঁড়ি ভেংগে দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক। তিনি তথ্য প্রকাশ করে বলেছেন,দেশের উচ্চ আদালতের রায়ে সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর এবং সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পূর্বাহ্নেই সরকার পুনঃমুদ্রিত সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের সার-সংক্ষেপ সংযুক্ত করেছিল। ব্যারিস্টার রফিক তাই ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল বিষয়ক উচ্চ আদালতের রায় সরকার প্রভাবিত হতেও পারে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। এ ব্যাপারে অতি চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে একটি বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক। উক্ত দৈনিকের একটি প্রতিবেদনে তথ্য প্রকাশ করে বলা হয় স্বাধীনতার ঘোষক বিষয়ক একটি রায় ঘোষণার পর বিচারপতি খায়রুল হকের সোনালী ব্যাংক, সুপ্রিমকোর্ট শাখার একটি একাউন্টে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ১০ লাখের বেশী টাকা জমা করা হয়েছিল। আদালত কর্তৃক শেখ মুজিবকে স্বাধীনতার ঘোষক রায় দেয়ার এটি নজরানা কী-না তা নিয়ে ব্যাপক গুঞ্জন রয়েছে। এ ব্যাপারে বিচারপতি খায়রুল হক ও সরকার পক্ষ জনগণকে প্রবোধ দেয়ার মত কোন যুক্তি এখনও উপস্থাপন করতে পারেননি বরং উল্টা-পাল্টা ও অসংলগ্ন কথা আসায় জনমনের সন্দেহকে আরও পাকাপোক্ত করা হয়েছে। মুন সিনেমা হলের মালিকানা নিয়ে রীট মোকদ্দমায় আদালত সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বাতিল করে দেশের উচ্চ আদালত ‘ধান ভানতে শীবের গীত’ পরিবেশন করেছেন কী-না তা নিয়ে অভিজ্ঞ মহলে ব্যাপক গুঞ্জন শোনা যায়। রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে হস্তক্ষেপের যুক্তিতে আদালত সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বাতিল করলেও সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ৪ মূলনীতির অন্যতম মূলনীতি গণতন্ত্র হত্যা করে একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করা হলেও আদালত এ ব্যাপারে সম্পর্ণ নীরব।
সর্বসাম্প্রতিক সময়ে দেশের নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালত পর্যন্ত বিচারের নিরপেক্ষতা নিয়ে মারাÍক প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। অতিসম্প্রতি একটি অতি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে গেছে জামায়াতের মহানগরী আমীর রফিকুল ইসলাম খানকে নিয়ে। পুলিশ নটরডেম কলেজের সামনে বাস ভাংচুরে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগে জনাব খানের বিরুদ্ধে একটি মামলা দিয়ে আদালতে হাজির করে রিমান্ড প্রার্থনার পর আদালতে প্রমাণ হয়েছে ঘটনার অনেক আগে থেকেই তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছিলেন। একজন কারাবন্দী কিভাবে রাজপথে গাড়ী ভাংচুরে নেতৃত্ব দিলেন, তা রীতিমত হাস্যরসের সৃষ্টি করে। আর কথিত মামলা আদালত কেন তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করে এজাহারকারী পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করার অভিযোগে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ হয়নি। উক্ত মামলায় আদালত জনাব খানের তখন রিমান্ড মঞ্জুর করেননি, কিন্তু তাকে জামিনও দেয়া হয়েছিল না। বিষয়টি কী বিচার বিভাগের ভাব-মর্যাদা বিনষ্ট করেনি?
দেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও মূলত এখনও বিচার বিভাগ ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা অনুসারে কাজ করছে। এ ব্যাপারে শুধু বিচারকদের দায়ী করলে তা সত্যের অপলাপই হবে। কারণ, এর জন্য প্রধানত দায়ী হলো রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর পশ্চাদমুখীতা ও নেতৃত্বের ব্যর্থতা। এসব কথা বলে বিচারকদের একেবারে দায়মুক্ত করার সুযোগ নেই। এর জন্য কতিপয় বিচারকের দাস মনোবৃত্তিও কম দায়ী নয়। বিচারকরা যদি আগে নিজেরা মানসিকভাবে স্বাধীন না হন তাহলে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদবেই। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বিচারকদের দাস মনোবৃত্তির অবসান হওয়া উচিত।
বিগত জরুরি সরকারের সময়ে বিচার বিভাগ স্বাধীন করা হলেও আওয়ামী লীগ সরকার অতি কৌশলে বিচার বিভাগের উপর ছড়ি ঘুরিয়ে যাচ্ছে। বিচারকদের নিয়োগ, বদলী, পদোন্নতিসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা এখনও সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে। এ বিষয়ে বিচারকদের পক্ষ থেকে অনেক প্রস্তাব এসেছে। সরকারের কর্তা ব্যক্তিরাও বিচার বিভাগকে স্বাধীন করার জন্য যথেষ্ট মায়াকান্না কেঁদেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি বরং দেশের বিচারালয়গুলো এখন সরকারি দলই নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই বিচার বিভাগ কাগজে-কলমে স্বাধীন হলেও বাস্তবে জনগণের সে দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন আজও অধরাই রয়ে গেছে। তাই জনগণ এখনও বিচার বিভাগের কাক্মিখত সেবা থেকে অনেকটাই বঞ্চিত।
এমনিতেই দেশের মানুষ বিচার বিভাগ সরকারি হস্তক্ষেপে যারপর নাই বিরক্ত। দেশের বিচার ব্যবস্থা ভাবমূর্তি ও আস্থার সংকটে পড়েছে। যে মুহূর্তে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনা সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি, তখন মাননীয় প্রধান বিচারপতির একটি মন্তব্যে দেশের মানুষ দারুণভাবে হতাশ হয়েছেন। মাননীয় প্রধান বিচারপতি গত ২৪ জুলাই টুংগী পাড়ায় সাবেক প্রেসিডেন্ট মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারত ও ফাতেহা পাঠ শেষে পরিদর্শন বহিতে লিখেছেন,‘বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত স্বপ্ন দেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট সদা সচেষ্ট। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রিয় গ্রাম বাংলায় শায়িত আছেন। বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধে এসে আমি মরহুমের আÍার মাগফিরাত কামনা করছি’।
দেশের বিচারালয় কোনো গোষ্ঠী বা বিশেষ কোনো দলের নয়। কোন বিশেষ উদ্দেশ্য বা আদর্শ বাস্তবায়ন বিচার বিভাগ বা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাজ নয়। বিচার বিভাগ মূলত দেশের সংবিধান রক্ষা ও এর ব্যাখ্যা প্রদান করে মাত্র। তাই মাননীয় প্রধান বিচারপতি তার মন্তব্যে শেখ মুজিবের স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তা কতখানি যুক্তিযুক্ত, সাংবিধানিক ও ন্যায়বিচারের সহায়ক তা নিয়ে অভিজ্ঞ মহলে নানান প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দায়িত্ব হলো ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা। তিনি সকল প্রকার দলমত, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে আবেগ, অনুরাগ ও বিরাগের ঊর্ধ্বে থেকে গণমানুষের জন্য সুবিচার নিশ্চিত করবেন। কিন্তু তিনি বিশেষ ব্যক্তি, বিশেষ আদর্শের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে মারাÍকভাবে হতাশ করেছেন এবং নিজের নিরপেক্ষতা হারিয়ে প্রধান বিচারপতির মতো মহান দায়িত্ব পালনের নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। কোনো বিচারপতির যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভংগী থাকতে পারবে না এমন নয় বরং থাকায় স্বাভাবিক এবং থাকবেও। কিন্তু তিনি যখন প্রধান বিচারপতির মতো দায়িত্বপূর্ণ ও সাংবিধানিক কাজে নিয়োজিত তখন চেয়ারে থেকে তার রাজনৈতিক আদর্শের প্রচার-প্রচারণা কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
তিনি বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত স্বপ্ন আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। কিন্তু এ স্বপ্ন শুধু বঙ্গবন্ধুর ছিল না বরং এ স্বপ্ন গণমানুষের। স্বপ্নটা যদি শেখ মুজিবের একার না হয়ে গণমানুষের হয়ে থাকে তাহলে তিনি বিশেষভাবে তার প্রিয় ব্যক্তিত্বের নাম উচ্চারণ করে নিজে কতটা বড়ত্বের পরিচয় দিয়েছেন,তার প্রিয়মানুষটিকেই বা কোনো মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন,নিজের পদমর্যাদার সাথে কতখানি সুবিচার করেছেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আসলে শেখ মুজিবের শেষ স্বপ্ন ছিল বাকশাল কায়েম। প্রকৃতই যদি শেখ মুজিবের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কথা বলে তাহলে বাকশাল প্রতিষ্ঠার কাজ করতে হবে। এটাই কি তিনি চান। মূলত সুপ্রীমকোর্টের প্রধান দায়িত্ব হলো আইনের শাসন ও মানবাধিকার নিশ্চিত করা। এ স্বপ্ন যদি কেউ দেখুক বা না দেখুক আদালত এ দায়িত্ব থেকে মুক্ত থাকতে পারেনা। কিন্তু প্রধান বিচারপতি তার প্রিয় মানুষ শেখ মুজিবকে জনসমক্ষে অতি বড় করতে গিয়ে তিনি যেমন তাকে মারাÍকভাবে বিতর্কিত করেছেন, ঠিক তেমনিভাবে নিজের পদ মর্যাদার সাথে সুবিচার করতে পারেননি। যদি বঙ্গবন্ধু আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন না দেখতেন তাহলে সুপ্রীমকোর্ট কী করতেন তা প্রধান বিচারপতির কাছে দেশের মানুষ জানতে চায়। মাননীয় প্রধান বিচারপতির মন্তব্য সম্পর্কে সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি ও সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আব্দুর রউফের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘এসব বিষয়ে আমার মন্তব্য করার রুচি আমার নেই। ব্যক্তি বিশেষের স্বপ্নই যদি সব কিছু হয়,তাহলে আদালতের কী দরকার’?
তিনি মরহুম শেখ মুজিবকে জাতির পিতা হিসাবে উলে¬খ করেছেন। কিন্তু শেখ মুজিবের জাতির পিতা হওয়ার বিষয়টি জাতীয়ভাবে স্বীকৃত নয়। বিশেষ একটি রাজনৈতিক দল ও আদর্শের লোকেরা মরহুম শেখ মুজিবকে জাতির পিতা বলতে পুলকবোধ করেন। তারা বড়জোর দেশের ৩০% লোকের প্রতিনিধিত্ব করেন। দেশের সিংহভাগে মানুষ জাতির পিতার ধারণাতেই বিশ্বাসী নয়। দেশের ৯০ ভাগ মানুষই মুসলমান। আর ইসলামী চিন্তাচেতনায় জাতির পিতার ধারণাটা সম্পর্ণ অগ্রহণযোগ্য। তাই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আবেগ-অনুভূতি, বোধ-বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শেখ মুজিবকে জাতির পিতা উলে¬খ করে তিনি কাকে খুশি করতে চেয়েছেন তা কারো কাছে বোধগম্য নয়। মূলত তিনি প্রধান বিচারপতির আসনকেই বিতর্কিত করেছেন। তার এমন মন্তব্য করা ঠিক হয়েছে কী-না বা তিনি স্বপদে বহাল থাকার অধিকার রাখেন কিনা তা নিয়ে তার মত প্রাজ্ঞ লোককেই ভাবতে হবে।
মূলত মরহুম শেখ মুজিব কতখানি আইনের শাসন ও মানবাধিকারের বিশ্বাস করতেন তা নিয়েও তো জনমনে নানান প্রশ্ন আছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবের ভাগিনা যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনি তো প্রকাশ্য জনসভায় বলেছিলেন, ‘‘দেশে আইনের শাসন চাইনা, বঙ্গবন্ধুর শাসন চাই’’। তিনি যদি এতোই মানবাধিকারে বিশ্বাসী হবেন তাহলে স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক মত পার্থক্যের কারণে ৪০ হাজার বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীকে কোন অধিকারে হত্যা করা হয়েছিলো? স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রক্ষীবাহিনীর জুলুম-নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা মানুষ এখনো ভুলে যায়নি। কলাপাতায় সম্ভ্রম ঢাকার স্মৃতি আজও বিস্মৃত হয়নি বাসন্তীরা। ক্ষুণ্ণিবৃত্তি নিবারণের জন্য লঙ্গরখানার পোড়া রুটির গন্ধ আজও মুছে যায়নি বুভুক্ষু মানুষের নাসিকা থেকে! সিরাজ শিকদারকে হত্যা করে সংসদে দাঁড়িয়ে দম্ভোক্তি কে করেছিলেন? প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার শাহেদ আলীর হত্যার কথা আজও দেশের মানুষ ভোলেনি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দেশের উচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে লাঠি মিছিল করে দেশে কোন আইনের শাসনের ইঙ্গিত দিয়েছিল? আওয়ামী লীগ যদি এতোই আইনের শাসনে বিশ্বাসী হয় তাহলে সুপ্রীম কোর্টে ভাংচুর ও প্রধান বিচারপতির এজলাসে পদাঘাতকারী ও হত্যা মামলার আসামী বিচারপতি হন কিভাবে? তারা যদি মানবাধিকারে এতোই বিশ্বাসী হয়ে থাকেন তাহলে কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে গণধিকৃত,মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী, মানবাধিকার, আইনের শাসন ও সংবিধান লঙ্ঘনকারী ১৯৭৩ সালের কালো আইনে বিনা অপরাধে একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের বিনা বিচারে আটক রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে কোন অধিকারে? এতে কী মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছেনা? সত্য কথনে অভ্যস্ত হলে সব সত্যই জনগণের কাছে প্রকাশ করতে হবে। মাননীয় প্রধান বিচারপতি জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন নিয়ে এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে বিশেষ দলের ক্রীড়নকে পরিণত হবেন না। ইতিহাস আপনাকে ক্ষমা করবেনা। আদালতের দায়িত্ব হলো জনগণের সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করতে ও দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা। কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের স্বপ্ন বাস্তবায়ন আদালতের কাজ নয়। আর যদি রাজনীতি করার ইচ্ছা থাকে তাহলে গাউন ছেড়ে রাজপথে আসুন। দেশের মানুষ আপনাকে আপনার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করবে না। লেখক বার্তা সংস্থা ফেয়ার নিউজ সার্ভিসের (এফএনএস) প্রধান সম্পাদক।
–
লেখক ও গবেষকঃ মুহম্মদ আলতাফ হোসেন এফএনএস’র সাবেক প্রধান সম্পাদক, কেন্দ্রীয় সভাপতিঃ জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা।
ই-মেইলঃ jss82bangla@gmail.com