# মুহম্মদ আলতাফ হোসেন #
আরব জাহানে প্রবল গণআন্দোলনের মুখে যখন গণতন্ত্রের আশাবাদ জাগছে তখন বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে হতাশা নেমে এসেছে। বৃটেনে দাঙ্গা হাঙ্গামা গ্রীস থেকে স্পেন পর্যন্ত ইউরোপীয় দেশগুলো ঋণভারে জর্জরিত, ভারতে দুর্নীতির ভয়াবহ বিস্তার বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রকে পঙ্গু করে ফেলছে। এছাড়া দেশটিতে রয়েছে ব্যাপক হারে অপুষ্টি এবং ভূমি সংস্কারের অভাব।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অর্থনৈতিক সংকট, বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝা ও রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছিলেন। তিনি বলেন, একমাত্র বিধাতাই জানেন ওয়াশিংটনে রাজনৈতিক পদ্ধতি অকোজো হয়ে পড়লো কি না।
স্বেরশাসকদের উৎখাতের লক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যখন তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক বিক্ষোভের বিস্তার ঘটছে তখন গণতান্ত্রিক বিশ্ব নানা রকম সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে। ওয়াশিংটন থেকে রোম হয়ে নয়াদিল¬ী পর্যন্ত সরকারসমূহকে ঋণ সংকট, সহিংসতা ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
অবশ্যই গণতন্ত্র হচ্ছে বহুমতের মিলন। যেখানে সকলেরই কথা বলার ও মত প্রকাশের অধিকার আছে। এখানে স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন মতের কারণে বিরোধ হতে পারে।
কিন্তু এ বছরটি প্রথম থেকেই একটু ভিন্ন ধরনের হয়ে দেখা দেয়। গ্রীসে যখন প্রতিবাদ বিক্ষোভ সহিংস দাঙ্গায় রূপ নেয় তখন কেউ কেউ অবাক হয়। অবশ্য রাস্তায় বিক্ষোভ বা দাঙ্গার একটা ইতিহাস রয়েছে দেশটির কিন্তু বৃটেনে ভয়াবহ দাঙ্গা হাঙ্গামা, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের এরকম ভয়াবহ বিস্তার কেউ আশা করেনি। এখানে যা ঘটেছে তা একেবারেই উদ্দেশ্যহীনভাবে।
বর্তমানে গণতান্ত্রিক যে প্রতিকৃতি দেখা যাচ্ছে তা আরবদের প্রত্যাশিত গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার সম্পর্ণ বিপরীত। বৃটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় বলা হয়েছে, মনে হচ্ছে যেসব জাতি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য দাবি জানাচ্ছে তাদের আমরা এমন উপকরণ দেখাচ্ছি যা একেবারেই মরচে ধরা ও ভোতা। এ বছরের শুরুতেই তিউনিসিয়ার লৌহ মানব প্রেসিডেন্ট জয়নাল আবেদীন বেন আলীর স্বৈরশাসকের নানপাশ ছিন্ন করার লক্ষ্যে গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। একজন তরুণের আÍহত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। কয়েকদিনের আন্দোলনেই বেন আলীর পতন ঘটে। এর পরপরই মিসরে গণতন্ত্রের স্বপ্ন নিয়ে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। তাহরির স্কোয়ারে উথলে ওঠে বিক্ষুব্ধ জন জোয়ারে। অবশেষে পতন ঘটে দীর্ঘ দিনের স্বৈরশাসক হোসনী মোবারকের। এই গণআন্দোলনের জোয়ার ছড়িয়ে পড়ে বাহরাইন, ইয়েমেন, লিবিয়া, সিরিয়া এবং এমনকি নীরবে নিভৃতে সুদূর চীনে পর্যন্ত।
স্বৈরশাসকদের পতন হবে বলে প্রথম দিকে আরব দেশগুলোর বিক্ষোভকারীদের মনে যে আশাবাদ জেগেছিল তা সবক্ষেত্রে পূরণ হয়নি। লিবিয়া, বাহরাইন, ইয়েমেন ও সিরিয়ার শাসকরা অত্যন্ত কঠোর ও নির্মমভাবে আন্দোলন মোকাবিলা করেছে। সিরিয়ায় এখনো প্রতিদিন সেনাবাহিনীর হাতে মানুষ মারা যাচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য দেশে আন্দোলন শক্তভাবে দানা বেঁধে উঠতে পারেনি। তবে এখনো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে গণতন্ত্রের দাবিদার হাজার হাজার বিক্ষোভকারীর জীবন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রগুলো খুব খারাপ একটি বছর পার করছে।
কাতারের ব্রুকিং দোহা সেন্টারের গবেষণা পরিচালক শাদি হামিদ বলেন, পাশ্চাত্যে এমন একটি মনোভাব রয়েছে যে, মৌলিকভাবে কিছু ভুল হয়েছে। অন্তত পক্ষে মিসর ও তিউনিসিয়ার ক্ষেত্রে এমন একটি ধারণা জন্মে যে এখানে আমাদের সবার ঘাড়েই দায়দায়িত্ব বর্তায়। তিনি বলেন, আরবরা বুঝতে পেরেছে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যকোন শক্তি তাদের পরিবর্তন এনে দেবে না। নিজেদের কাজ নিজেদেরই করতে হবে। তারা বলছে আমাদের যথেষ্ট হয়েছে, আমরা আর কারো জন্য অপেক্ষা করবো না। যদি আরব পুনর্জাগরণ আংশিকও সফল হয় তাহলে ফলত বিশ্ব রাজনীতি পাল্টে যেতে পারে এবং বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রগুলো তারা পেছনে ঠেলে দিতে পারে। এটা নিশ্চিত যে, লন্ডনের সহিংসতাকে অনেকেই সহজভাবে লুটতরাজ হিসেবেই দেখে থাকেন। তবে এটা তাদের সংস্কৃতি যে গভীর সমস্যায় আছে তার প্রতিফলন ঘটেছে এতে। প্রথমে দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলে এই সহিংসতা দেখে দিলেও পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েট, অল্প বয়েসী ব্যালে ণর্তকী, কলেজ ছাত্র থেকে শুরু করে ধনী পরিবারের সন্তানরাও এ লুটপাটে অংশ নেয়। বিশ্বের যে কোন স্থানে এই পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ বৃটেনের দাঙ্গার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। সিরিয়ার একজন কূটনীতিক গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলন (যে আন্দোলন স্বৈরশাসকের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে) এর সঙ্গে বৃটেনের লুটতরাজের তুলনা করেছেন। মালয়েশিয়ার পুলিশ সম্প্রতি নির্বাচন সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের কাঁদানে গ্যাস ও পানি কামান ব্যবহার করে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে এবং ১৬শ’র বেশি লোককে আটক করেছে। সে দেশের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা বৃটেনের দাঙ্গা হাঙ্গামাকে এর যথাযথ তার প্রমাণ হিসেবে দেখেছেন।
পুলিশের উপ প্রধান খালিদ আবু বকর এক বিবৃতিতে বলেন, বৃটেনের দাঙ্গা ছিল একটা দুঃস্বপ্নের মত। আমরা এ ধরনের ঘটনা পরিহার ও প্রতিরোধে কঠোর পরিশ্রম করেছি। আল হামদুলিল¬াহ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছি। সুতরাং বৈপরীত্ব কেন? কিছু ধনী গণতন্ত্রকে অসংখ্য সমস্যার সঙ্গে সংগ্রাম করতে হচ্ছে আবার বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত নিপীড়িত লোকেরা স্বৈরশাসকদের চ্যালেঞ্জ অকুতোভয়ে মোকাবিলা করে যাচ্ছে। সম্ভবত এটা ঘটছে এ কারণে যে, ধনী গণতন্ত্রগুলোকে যতখানি সমৃদ্ধশালী মনে করা হতো আসলে তারা ততটা নয়। পাশ্চাত্য দেশগুলোর গত কয়েক বছরের ঘটনাবলীর দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, দেশগুলো মারাÍক ঋণ জর্জরিত। সরকারের দূরদর্শিতা ঘাটতি ও গোপন বাজেট ঘাটতি প্রকট, দু’এক বছর আগেও যুক্তরাষ্ট্রকে ভাবা হতো বিশ্বের অপ্রতিদ্বনদ্বী অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে দেশটির অর্থনীতি আস্তে আস্তে গ্রাস করছে চীন।
আরব বিশ্বের গণতন্ত্র সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার সময় এখনো আসেনি। কিংবা পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন একথাও এখন বলা যাবে না। ইসরাইলের পররাষ্ট্র দফতরের সাবেক পরিচালক ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক শালোমো আভিনারি বলেন, ইসরাইলসহ গণতান্ত্রিক দেশগুলো মারাÍক নীতি সমস্যায় ভুগছে। তবে তাদের এ সমস্যা গণতন্ত্রের সঙ্গে সংশি¬ষ্ট নয়। দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছাড়া এসব সমস্যার সমাধান কিভাবে করা যায় তা নিয়ে কাজ করে গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে।
সুতরাং প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রগুলো দাঙ্গা-হাঙ্গামা ঋণ সমস্যা ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা থাকা সত্ত্বেও অন্ততপক্ষে এটুকু বলা যায় তাদের গণতন্ত্রও আছে।
–
লেখক ও গবেষকঃ মুহম্মদ আলতাফ হোসেন এফএনএস’র সাবেক প্রধান সম্পাদক, কেন্দ্রীয় সভাপতিঃ জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা।
ই-মেইলঃ jss82bangla@gmail.com