# মুহম্মদ আলতাফ হোসেন #
সফল গণজাগরণের মধ্যদিয়ে আরব দেশগুলো গণতন্ত্রকে বরণ করে নিচ্ছে এবং পাশাপাশি রাজনীতিতে ইসলামের ভূমিকাকেও সেসব দেশের রাজনীতিতে স্বাগত জানানো হচ্ছে। কিন্তু রাজনীতিতে শরিয়াহ
বা ধর্মের ভূমিকা প্রশ্নে ইসলামপন্থীরা যে বিবৃতি দিচ্ছেন সেখানে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ইসলামের ভূমিকার প্রশ্নে স্পষ্ট কোনো রূপরেখা উপস্থিত দেখা যাচ্ছে না। গত ২৩ অক্টোবর সম্পন্ন তিউনিশিয়ার
নির্বাচনে ইসলামের মধ্যপন্থী অনুসারীরা দৃঢ় অবস্থানে আসীন হয়েছেন। লিবিয়ায় এনটিসি নেতা মুস্তফা আব্দুল জলিল দেশের শাসনতন্ত্রে শরিয়াহকে সর্বোচ্চ স্থান দেবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন।
নতুন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলামকে আরো অধিকতর মাত্রায় অঙ্গীভূত করে নেয়ার পদ্ধতি প্রকরণ নিরূপণে ইসলামপন্থীদের এখন অবশ্যই আরো বেশি যত্নবান হতে হবে। ইসলামকে গণতন্ত্রের অঙ্গীভূত
করার আলোচনায় ব্যবহৃত বহু শব্দই দ্ব্যর্থবোধক প্রতিভাত হয় এবং বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায় অমুসলিমরা প্রায়শই শরিয়ার ভুল অর্থ করে থাকেন। ১২টি দেশে শরিয়ার কিভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে –
স¤প্রতি সে সম্বন্ধে জরিপ চালাতে গিয়ে আইনবিষয়ক এক ডাচ অধ্যাপক জান মিশিয়েল অটো বলেছেন, রাজনীতিতে ইসলামকে সামিল করা হলে রাজনীতির বহু বিস্তৃত পরিসর ইসলামের আওতায় এসে
যায়।
‘‘শরিয়াহ ইনকম্পেরিটেড’’ বইয়ের সম্পাদক লীডেন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর জান মিশিয়েল অটো বলেন, শরিয়াহ প্রয়োগে আপনার প্রাপ্তিযোগ কী হতে যাচ্ছে, আপনি আগাম বলতে পারেন না। তাঁর
গবেষণার ফলশ্রুতি হচ্ছে, ইসলামের ব্যাপক প্রয়োগে স্বাধীনতা খর্বিত হয়- বহু পশ্চিমা বিশ্লেষকের এই অভিমত সঠিক নয়।
কোলিয়ায় সেলজুক ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত তুর্কী সমাজবিজ্ঞানী ইয়াসিন আক্তাই বলেন, শরিয়াহ বলতে আইনের সুনির্দিষ্ট শব্দসমন্বিত ব্যাখ্যা বোঝা ঠিক হবে না। কিন্তু শারীরিক দন্ড প্রয়োগেই শরিয়ার
কার্যকারিতা সীমাবদ্ধ থাকতে হবে- মনে করাও যথার্থ হবে না।
মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মস্বরূপ ইসলামকে ইতোমধ্যেই অঙ্গীভূত করা হয়েছে এবং শরিয়াহকে আইনের উৎস বলা হয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি পশ্চিমের আদলে দেশগুলোয় দেওয়ানী ফৌজদারী
বিধিমালাও কার্যকর রয়েছে।
সৌদি আরবকে বাদ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় ধর্মীয় ও দেওয়ানী আইনের জটিল সংমিশ্রিত প্রয়োগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শরিয়ার প্রয়োগ কোনো কোনো দেশে হচ্ছে প্রতীকী অর্থে। কোথাও পরিমিত
পরিসরে আবার কোথাও কোথাও কঠোরভাবে।
তিউনিশিয়ায় আইন পরিষদের ভোটে ইসলামপন্থী আন-নাহদা বিজয়ী হয়েছে। ইসলামের তাদের অভিপ্রেত প্রয়োগ-পরিসীমা আন-নাহদাই সর্বপ্রথম স্পষ্ট শব্দে উল্লেখ করতে শুরু করেছে। তাদের ভাষায়
তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সম্মান করে এবং নতুন সংবিধান প্রণয়নে ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে তারা কাজ করতে ইচ্ছুক। আন-নাহদা নেতা রশিদ গানুসি বলেছেন, তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল
একে পার্টির মতো মধ্যপন্থী ইসলামী রাজনীতি আন-নাহদা অনুসরণ করতে চায়। তিউনিশিয়ার সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বলা হয়েছে। কিন্তু আইনের ভিত্তিস্বরূপ শরিয়ার উল্লেখ সেখানে করা হয়নি।
ধর্মনিরপেক্ষতার দৃঢ় ঐতিহ্যপুষ্ট তিউনিশিয়ায় শরিয়াহকে আইনের ভিত্তি ঘোষিত করা হলে আন-নাহদাকে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হবে।
আক্তাই বলেন, ১৯৮০-র দশকে গানুসির লেখাজোখায় প্রভাবিত হয়েই তুরস্কের ইসলামপন্থীরা শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের দৃষ্টিভঙ্গী পরিহার করে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে প্রবেশে উদ্যোগী হন। তুরস্কে একে
পার্টিও সাফল্যে অনুপ্রাণিত গানুসি এরপর তিউনিশিয়ার সরেজমিন রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।
অপর দিকে মিসরে ডিসেম্বরের শুরুর দিকে নতুন নিম্নকক্ষের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। মিসরের সংবিধানেও ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং একই সঙ্গে ইসলামকে আইনের
মূল উৎস বলা হয়েছে। সেখানে মুসলিম ব্রাদারহুড সর্ববৃহৎ দল হিসেবে বেরিয়ে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক জোট গড়ার ব্রাদারহুডের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। উদারপন্থী ও প্রতিদ্বনদ্বী বহু
ইসলামপন্থী গোষ্ঠী জোট গড়তে রাজী না হয়ে নিজেদের পৃথক জোট গড়তে তৎপর হয়েছে।
লিবিয়ায় সাবেক একনায়ক মুয়াম্মার গাদ্দাফি শাসনকর্তৃত্ব চালিয়ে এসেছিলেন অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে। ইসলামকে সেখানে রাষ্ট্রধর্ম বলা হয়েছিল এবং শরিয়াহকে কিছু কিছু আইনের অনুপ্রেরণার উৎস বলে
উল্লেখ করা হয়েছিল। এনটিসি চেয়ারম্যান জলিল গত ২৩ অক্টোবর ঘোষণা করেন, লিবিয়ায় আইনের উৎস হবে শরিয়াহ। সেপ্টেম্বরের শুরুতে জঙ্গি মতবাদ বরদাশ্ত্ করা হবে না উল্লেখসহ তিনি বলেছিলেন,
আমরা আইনের শাসন চাই, উন্নয়ন চাই এবং আমাদের সংবিধানে আইনের প্রধান উৎস থাকবে শরিয়াহ। লিবিয়ায় মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যসংখ্যা হচ্ছে এক হাজারেরও কম। কারণ, সদস্যসংগ্রহে
গাদ্দাফির আমলে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ছিল। কেবল উচ্চশিক্ষিত কিছু লোকজন তাদের মতবাদে আকৃষ্ট হতেন। অতএব আরব রাজনীতিতে ইসলাম এখন একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বিষয়। নতুন
প্রজন্মের নেতৃবর্গ ইসলামকে কী অর্থে ব্যবহার করবেন সেটাই দেখার বিষয়।
–
লেখক ও গবেষকঃ মুহম্মদ আলতাফ হোসেন এফএনএস’র সাবেক প্রধান সম্পাদক, কেন্দ্রীয় সভাপতিঃ জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা।
ই-মেইলঃ jss82bangla@gmail.com