# মুহম্মদ আলতাফ হোসেন #
গণমাধ্যমকে সমাজের দর্পণ বলা হয়। অবাধ তথ্য প্রবাহ ও বাক স্বাধীনতার বিষয়টি এর সাথে জড়িত। সরকার নিজেদেরকে গণমাধ্যম বান্ধব বলে জাহির করলেও তারা এ শিল্পের উপর অনাকাক্মিখত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার জন্যই ‘বেসরকারী গণমাধ্যম নীতিমালা’র খসড়া প্রণয়ন করে তথ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে জমা দিয়েছে। প্রস্তাবিত খসড়া এ নীতিমালা আইনে পরিণত হলে গণমাধ্যমগুলোর ওপর সরকারের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে এবং এই শিল্পের স্বাধীনতা বলতে কিছুই থাকবে না। এতে দেশের গণমাধ্যমগুলো মূলত অকার্যকর হয়ে পড়বে। আসলে আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় আসে তখনই ভিন্নমতের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালে ১৬ জুন তৎকালীন বাকশাল সরকার স্বৈরাচারী ও ফ্যাসীবাদী শাসন কায়েমের লক্ষ্যে এবং জুলুম-নির্যাতনকে নির্বিঘ্ন করার জন্য The Newspaper (Announcement of Declaration) Act-1975 জারি করে ৪টি সংবাদপত্র ছাড়া বাকিগুলো বন্ধ করে দেয়। এতে গণমাধ্যমের কন্ঠরোধ করা হয় এবং হাজার হাজার গণমাধ্যম কর্মী চাকরি হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হন। বাকশালী সরকার এই এ্যাক্ট পাশের আগেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করে আসছিলো। ১৯৭৩ সালের ২৯ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে দৈনিক গণকন্ঠ সম্পাদক জনাব আল-মাহমুদ অভিযোগ করেছিলেন, ‘গণকন্ঠ অত্যন্ত বেআইনীভাবে বন্ধ করিয়া দেয়ার ফলে তথাকার পৌনে তিনশ’ সাংবাদিক ও কর্মচারি বেকার হইয়া পড়িয়াছেন। সাংবাদিক ও কর্মচারীদের মুহূর্তমাত্র সময় না দিয়া অফিস হইতে কাজ অসমাপ্ত রাখা অবস্থায় বাহির করিয়া দেয়া হইয়াছে’। (ইত্তেফাক-৩০ মার্চ ১৯৭৩) মূলত আওয়ামী লীগ বাকস্বাধীনতা বিরোধী একটি ফ্যাসীবাদী শক্তি। তারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা ও গণমাধ্যম্যের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। তারা আধিপত্যবাদের তল্পিবাহক ও সাম্রাজ্যবাদের সহায়ক শক্তি।
পরমতসহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের মূল উপাদান। বাক স্বাধীনতা না থাকলে গণতন্ত্র হয়ে ওঠে অর্থহীন। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকের কতিপয় অধিকার সংরক্ষণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এর বিনিময়ে নাগরিক রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিক তিন ধরনের অধিকার ভোগ করবে- ১. সামাজিক অধিকার, ২. রাজনৈতিক অধিকার এবং ৩. অর্থনৈতিক অধিকার। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে নিম্নে নাগরিক অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হলো :
সামাজিক অধিকার :
১. জীবনধারণের অধিকার, ২. ব্যাক্তি স্বাধীনতার অধিকার, ৩. মতপ্রকাশের অধিকার, ৪. সভা-সমিতির অধিকার, ৫. সম্পত্তি ভোগের অধিকার, ৬. ধর্মীয় অধিকার,৭. আইনের অধিকার, ৮. চুক্তির অধিকার, ৯. ভাষার অধিকার, ১০. পরিবার গঠনের অধিকার, ১১. শিক্ষা লাভের অধিকার।
রাজনৈতিক অধিকার :
১. ভোটাধিকার, ২. প্রার্থী হওয়ার অধিকার, ৩. অভিযোগ পেশ করার অধিকার, ৪. সমালোচনা করার অধিকার, ৬. চাকরি লাভের অধিকার ও ৭. বসবাসের অধিকার।
অর্থনৈতিক অধিকার :
১. কাজের অধিকার, ২. উপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভের অধিকার, ৩. অবকাশ যাপনের অধিকার, ৪. সংঘ গঠনের অধিকার ও ৫. রাষ্ট্র প্রদত্ত প্রতিপালনের অধিকার ইত্যাদি।
উপরে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকদের যেসব অধিকারের কথা বলা হলো সেসব ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সরকারের প্রস্তাবিত গণমাধ্যম নীতিমালায় রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মারাত্মকভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র জনগণের শাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও স্বাধীন গণমাধ্যমকে সরকার মোটেই গুরুত্ব না দিয়ে তাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্যই গণতান্ত্রিক সকল রীতিনীতি উপেক্ষা করে গণমাধ্যমে টুটি চেপে ধরার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। যা আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য রীতিমত অশনি সংকেত। মূলত শাসনকার্যে জনগণের সম্পৃক্ততা উপেক্ষা করে দেশকে এগিয়ে নেয়া মোটেই সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক লাস্কি বলেন, The single unit of population in the state could say or unsay the function of the state if it is given priority of evaluated. . অর্থাৎ ‘জনগণকে মূল্যায়িত করা হলে জনগণ রাষ্ট্রীয় কাজকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে’।
এ্যাডওয়ার্ড শিলস (Shils) বলেন, The power of state can be controlled and moderated by the spontaneos participation of the general mass. অর্থাৎ ‘জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ ও কার্যকর করে তুলতে পারে’।
আওয়ামী লীগ বরাবরই গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না কাঁদলেও মূলত তারা গণতন্ত্র বিরোধী একটি ফ্যাসীবাদী অপশক্তি। তাদের রাজনীতির মূলমন্ত্র হচ্ছে নৈতিক ও অনৈতিক যে কোন পন্থায় ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত ও দীর্ঘায়িত করার জন্য যা যা করা প্রয়োজন তাই করা। এ জন্য তারা নাৎসীবাদ, সর্বাত্মকবাদ ও ফ্যাসীবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। তারা ক্ষমতাকে টিকে রাখার জন্য হেন কৌশল নেই যা তারা অবলম্বন করতে কুন্ঠাবোধ করবে। নিম্নে এসব মতবাদ সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনা পেশ করা হলো :
নাৎসীবাদ : ১৯৩২ সালে হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানীর নাৎসী দল প্রতিষ্ঠিত হয়। ফ্যাসীবাদ ও নাৎসীবাদের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য ছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের পর ফ্যাসীবাদ ও নাৎসীবাদ ইউরোপে সাময়িক সাফল্য লাভ করে জনগণের বিভিন্ন সমস্যা ক্ষিপ্রতার সাথে সমাধান করে মন্থর গতি সম্পন্ন গণতন্ত্রের এক শক্তিশালী প্রতিদ্বনদ্বী হিসাবে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল।
নাৎসীগণ রাষ্ট্রকে সর্বগ্রাসী এবং সর্বশক্তিমান মনে করতো। ‘ব্যক্তি রাষ্ট্রের জন্য, রাষ্ট্র ব্যক্তির জন্য নয়’ এই ছিল তাদের মূলনীতি। তাই জার্মানীর জনগণ হিটলারের আদেশে কেবল ব্যক্তি স্বার্থই নয়, ধন-প্রাণ, বিচার, বুদ্ধি পর্যন্ত দিয়ে বসেছিল। হেগেলীয় দর্শনের প্রভাব এবং নীটসের আদর্শের প্রভাবে রাষ্ট্র একটি রহস্যজনক সর্বশক্তিমান প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। এতে গণতন্ত্রের কোনই স্থান ছিল না। নেতার আদেশই রাষ্ট্রের আদেশ হিসাবে গণ্য হতো।
সর্বাত্মকবাদ : গত শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে অষ্টম দশক পর্যন্ত সর্বাত্মকবাদ শুধু মতবাদই ছিল না, বহু সমাজে এটা ছিল বাস্তবতা। স্নায়ু যুদ্ধ অবসানের পরে, বিশেষ করে গণতন্ত্রের জয়যাত্রা, বাজার অর্থনীতির বিশ্বময় গতিশীলতা, তথ্য ক্ষেত্রে বিপ্লব প্রভৃতির জন্য সর্বাত্মকবাদ নিঃশেষ হয়েছে।
সর্বাত্মকবাদ বলতে এমন আদর্শকে বোঝায় যার ফলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের এমন বিন্যাস ঘটে যে, সমগ্র সমাজব্যাপী সরকারী কর্তৃত্ব স¤প্রসারিত হয়। এতে সরকারি কাঠামো এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় যে, জনগণের জীবনের সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। মানুষের শিক্ষা-সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, পোষাক-পরিচ্ছদ, চিন্তা-ভাবনা, ধর্মবিশ্বাস, সবকিছুই রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হলো :
১. সর্বোচ্চ ক্ষমতা এক নায়কের হাতে ন্যস্ত, ২. রাষ্ট্রই সবকিছু অর্থাৎ সমাজ জীবনে রাষ্ট্রই হলো মূখ্য, ৩. অগণতান্ত্রিক অর্থাৎ ব্যক্তিকে সর্বোতভাবে সরকারের নীতি ও কার্যক্রমে নিবেদন করতে হয় এবং সরকারের প্রতি ভিন্নমত প্রকাশের কোন সুযোগ নেই. ৪. ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী, ৫. সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল থাকে, ৬. এ মতবাদের সরকার হয় নিকৃষ্টতম।
২. ফ্যাসীবাদ : পুঁজিবাদ, সম্রাজ্যবাদী একচেটিয়া মহাজনী মূলধনের চরম জাতীয়তাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল ও সন্ত্রাসমূলক প্রকাশ হচ্ছে ফ্যাসীবাদ। ফ্যাসীবাদ চরম জাতীয়তাবাদ, অযৌক্তিক ধর্ম ও বর্ণবিদ্বেষ এবং উদ্দেশ্য সাধনে চরম বর্বরতার আদর্শ প্রচার করে। ফ্যাসীবাদ পুঁজিবাদের চরম সংকটের পরিচয় বাহক। সাম্রাজ্যবাদী যুগ হচ্ছে পুঁজিবাদের চরম যুগ। জাতীয় ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের বিকাশ যখন নিঃশেষিত, তখন পুঁজিবাদ নিজের শোষণমূলক ব্যবস্থা কায়েম রাখার জন্য সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র গ্রহণ করে। ফ্যাসীবাদের মূলনীতিগুলো নিম্নরূপ :
ক. প্রথমত, ফ্যাসীবাদ গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল নয়। মূলত ফ্যাসীবাদে ছোট, মধ্যম, বড় এবং সর্বোচ্চ নেতা যা আদেশ করবেন, তাই রাষ্ট্রের আদেশ বলে নির্বিবাদে মেনে নিতে হবে।
খ. ফ্যাসীবাদ সমাজতন্ত্রকেও অবিশ্বাস করে।
গ.ফ্যাসীবাদে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য স্বীকৃত হয় না। ফ্যাসীবাদের মূলমন্ত্র হলো সবকিছুই রাষ্ট্রের আওতার্ভুক্ত, কোন কিছুই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয় এবং কোন কিছুই রাষ্ট্রের বাহিরে নয়।
ঘ. ফ্যাসীবাদ শান্তি কামনা করে না। ফ্যাসীবাদ নিয়ত সংগ্রামে লিপ্ত থাকার অনুপ্রেরণা যোগায়। মুসোলিনির মতে মহিলাদের নিকট যেমন মাতৃত্ব, পুরুষদের নিকট তেমন যুদ্ধ বিগ্রহ।
ঙ. একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় এবং দলীয় নেতা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে আসীন হন। একদল এবং এক নেতা সরকারের এবং সমাজের সকল কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করেন।
চ. ফ্যাসীবাদে এলিট শ্রেণীর শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে বিশ্বাস করা হয় যে, পৃথিবীতে কিছু ব্যক্তি শাসন করতে এবং শাসিত হবার জন্য জন্মগ্রহণ করেছে।
উপরের আলোচনা থেকে নাৎসীবাদ, সর্বাত্মকবাদ ও ফ্যাসীবাদের যে চরিত্রের সাথে আমরা পরিচিত হলাম, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে তার সবকিছুই বিদ্যমান। তারা কখনোই গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিল না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে তারা ক্ষমতায় আসলেও ১৯৭৫ সালে তারা জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মাত্র তের মিনিটের ব্যবধানে সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র হত্যা করে একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করেছিল। এর আগে তারা সংবাদ মাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে ভিন্নমত প্রকাশকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের এক রক্তাক্ত রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে আবারও একদলীয় বাকশালী শাসনের পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়। কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয় যে, যে শক্তি দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র হত্যা করে একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করেছিল তাদের কাছেই এ জাতিকে গণতন্ত্রের দীক্ষা নিতে হচ্ছে। তারা আবারও দেশে একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করতে চায়। আর সে কথার প্রমাণ মেলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের সর্বসা¤প্রতিক বক্তব্য থেকে। তিনি রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় বলেছেন, আওয়ামী লীগ এখনো বাকশালী চেতনায় বিশ্বাস করে’। আর তারা আবার নতুন করে গণমাধ্যম নীতিমালা তৈরি করে গণমানুষের কথা বলার স্বাধীনতা হরণ করতে চায়।
প্রস্তাবিত বেসরকারী স¤প্রচার নীতিমালায় বলা হয়েছে যে, ‘কোন আলোচনামূলক অনুষ্ঠানে কোন ধরনের অসঙ্গতিপূর্ণ বিভ্রান্তিমূলক তথ্য বা উপাত্ত দেয়া যাবে না। প্রয়োজনে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে টেলিভিশন বা রেডিও বা অনুষ্ঠান পরিচালক জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবেন। রাজনীতি বিষয়ে নেতিবাচক কিছু প্রচার করা যাবে না। বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয় এমন কোন বিষয়ে প্রচার চালানো যাবে না। সরাসরি বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোন রাজনৈতিক দলের বক্তব্য বা মতামত প্রচার করা যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোন বিদ্রোহ, নৈরাজ্য বা হিংসাত্মক ঘটনা প্রদর্শন করা যাবে না। রাজনৈতিক ব্যক্তি, বিদেশী কুটনীতিক ও জাতীয় বীরদের পণ্যের বিজ্ঞাপনে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। রেডিও, টেলিভিশন চ্যানেল নিজ দায়িত্বে বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত ছাড়পত্র প্রদান করতে হবে এবং এক্ষেত্রে টেলিভিশন বিজ্ঞাপন নীতিমালা সঠিকভাবে অনুসরণ করা না হলে তথ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট টিভি চ্যানেলের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে’।
প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়েছে, ‘জাতীয় আদর্শ ও উদ্দেশ্যের প্রতি কোন ধরনের ব্যঙ্গ বা বিদ্রূপ, বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের জাতীয় চরিত্রের প্রতি কটাক্ষ অথবা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের অখন্ডতা ও সংহতি ক্ষুণ্ণ হতে পারে এমন প্রবণতা সম্পর্কিত কোন অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিপণ্ণ করতে পারে এমন ধরনের সামরিক বা সরকারি কোন তথ্য ফাঁস করা যাবে না। কোন বিদেশী রাষ্ট্রের অনুকুলে কোন ধরনের প্রচারণা, যা বাংলাদেশ ও সংশ্লিষ্ট দেশের বিরোধের কোন একটি বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারে এমন ধরনের সামরিক বা সরকারি কোন তথ্য ফাঁস করা যাবে না। দেখানো যাবে না কোন জনগোষ্ঠী, জাতি বা দেশের মর্যাদা বা ইতিহাসের ঘটনা/দৃশ্যবিন্যাস। ওয়াজ মাহফিল, ওরশ, পূজা, বড়দিন, বুদ্ধ পূর্ণিমা ইত্যাদি ধর্মবিষয়ক বিজ্ঞাপন প্রচারের আগে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে’।
উপরোল্লিখিত এ নীতিমালার অধিকাংশই হবে নিশ্চিতভাবে স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য হুমকি স্বরূপ। জনগণের সাংবিধানিক অধিকারে হস্তক্ষেপের শামিল। একুশ শতকের পৃথিবী যখন অবাধ তথ্যপ্রবাহের উন্মুক্ত সরব পদচারণার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে, তখন এমন কঠোর ও পশ্চাৎমুখী নীতিমালার আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলা গণমাধ্যমের ওপর সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপের শামিল। যা সেই অতীতের বাকশালী শাসনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
সরকার নতুন করে গণমাধ্যম নীতিমালা প্রণয়ন করায় দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এর তীব্র সমালোচনা করেছেন। কিন্তু সরকার সমর্থকদের এ সম্পর্কে সতর্ক মন্তব্য করতে দেখা গেছে। সরকারের ঘোরতর সমর্থক বলে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ আ স ম আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, তিনি মনে করেন, ‘সরকার এটি আরও নিরীক্ষা করে দেখবে’। তার মতে, ‘স্বাধীন গণমাধ্যম প্রবাহ অব্যাহত রাখতে সরকার নিশ্চয় সতর্ক হবে’।
বিশিষ্ট গণমাধ্যম বিশ্লেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের খন্ডকালীন শিক্ষক ও এসোসিয়েটেড প্রেস-এপির বাংলাদেশ ব্যুরো চীফ ফরিদ হোসেনের মতে, ‘যে সমপ্রচার নীতিমালা সরকার করেছে, এটা গণমাধ্যমে সরকারের হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি করবে। সরকার যে স্বাধীন গণমাধ্যমের কথা বলছে, এটা তার সম্পূর্ণ পরিপন্থী’। তিনি বলেন, ‘নিঃসন্দেহে বলা যায় এ নীতিমালা স্বাধীনভাবে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের কাজ করার ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসাবে কাজ করবে। এখানে এমন কিছু বিষয় আছে, যেগুলো সংবিধানে আছে। যেমন বন্ধু রাষ্ট্রের বিষয়ে এমন কিছু বলা যাবে না যাতে সম্পর্ক নষ্ট হয়। তবে এটা বলতে নতুন খসড়া নীতিমালায় কী বোঝানো হচ্ছে সরকারকে তার একটা ব্যাখ্যা দিতে হবে।
ফরিদ হোসেন বলেন, ‘সরকার একটা নীতিমালা করবে, সেটি সবার মত নিয়ে, স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য যেটা ভালো হয়, এমন নীতিমালায় প্রণয়ন করা উচিত। কিন্তু হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করা কোনভাবেই উচিত হবে না। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বা বিজ্ঞাপন দেখার জন্য যদি আলাদা বডি থাকে তাহলে তো তারা একটা সংকট তৈরি করতে পারে এবং তা চ্যানেলগুলোর জন্য একটা বড় বিড়ম্বনার কারণ হতে পারে’। তার মতে, ‘নীতিমালাটি এমন হওয়া উচিত যা পালনে চ্যানেলগুলোর স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে। চাপিয়ে দেয়া কোন বিষয় ভালো ফল বয়ে আনতে পারে না’।
দেশের প্রথম ডিজিটাল বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ বলেন, ‘এ নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে স¤প্রচার মাধ্যমে একটা ‘বিজাস্টার’ হবে। দেশে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের বড় ধরনের বিকাশ হয়েছে। সেটার কল্যাণে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে’। তিনি বলেন, ‘সরকারের খসড়া নীতিমালাটি আমি পড়েছি। আমার মনে হয়, এটা গণতন্ত্রের ওপর প্রচন্ড আঘাত। এটা একটা আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত হবে, যদি সরকার এটিই চুড়ান্ত করে ফেলে। সংবিধানে বাকস্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে অথচ এখানে তার সাথে কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না’। শাইখ সিরাজ বলেন, ‘সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলছে, আবার এ রকম বাধা তৈরি করছে, যাতে অবাধ তথ্য-প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে, দু’টো একসাথে হতে পারে না’। তিনি বলেন, ‘নীতিমালাটি খুবই কঠিন। আমরা চাই এটি সহজ হোক। এখানে একটা নির্দেশনা থাকতে পারতো, যেটা আমরা গাইড লাইন বলতে পারতাম। তা না করে নীতিমালা করার দরকার ছিল না’।
সরকার নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য ইতোমধ্যেই মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা যেকোন ভাবে তাদের আসন্ন পতনকে ঠেকাতে চায়। তাই রাষ্ট্রের সকল সেক্টরকে দলীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আগামী দিনে তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে চায়। তারা জনগণের ভয়ে এতই ভীত হয়ে পড়েছে যে, তারা মসজিদে ঈমাম সাহেবদের খুৎবা নিয়েও আতংকে আছে। জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, ‘ঈমামদের খুৎবা মনিটরিং করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়’। (১৮ সেপ্টেম্বর/সংবাদ) এ থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, সরকার ইতোমধ্যেই গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পতনের জন্য প্রহর গুণতে শুরু করেছে। কিন্তু সরকার এই আসন্ন পতনকে প্রলম্বিত করার জন্যই সরকার খড়কুটার আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু এসব করে অতীতে কেউ শেষ রক্ষা করতে পারেনি।
আওয়ামী লীগ সরকার সাংবিধানিকভাবে আবারও বাকশালের দিকে ফিরে না গেলেও এমনভাবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এনেছে যাতে বাকশালী চিন্তা-চেতনারই প্রতিফলন ঘটেছে। সরকার জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ধারাবাহিকতার পথে রুদ্ধ করেছে। সরকার দেশের আদালতগুলোকেও দলীয় কার্যালয়ে পরিণত করেছে। রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রেই সরকার নগ্ন হস্তক্ষেপের মাধ্যমে পুরো দেশেই অচলাবস্থার সৃষ্টি করে রেখেছে। তারা সর্বশেষ হাত দিয়েছে স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর। এক্ষেত্রে তারা যদি সফল হতে পারে তাহলে ভিশন ২১ বাস্তবায়ন করা আওয়ামী লীগের জন্য খুবই সহজ হবে। এছাড়া আরও বিশেষ একটি কারণে সরকার পুরো গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায়। আর তা হলো ভারতের সাথে সরকারের একতরফা চুক্তি। সরকার এসব চুক্তি সম্পর্কে তো দেশের মানুষকে অবহিত করেইনি বরং জাতীয় সংসদও নয় সরকারের মন্ত্রী পরিষদেও এসব বিষয়ে কোন আলোচনার সুযোগ রাখা হয়নি। এসব বিষয়ে দেশের গণমাধ্যমগুলো সোচ্চার বলেই সরকার নতুন করে গণমাধ্যম নীতিমালার মাধ্যমে সংবাদ মাধ্যমের ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ করতে চায়। কিন্তু অতীতে গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে কোন সরকারই সুবিধা করতে পারেনি। স্বৈরাচার আইয়ুব খান, শেখ মুজিব, জেনারেল এরশাদ তাদের শেষ রক্ষা করতে পারেননি। কিন্তু আওয়ামী লীগ খুব সুবিধা করতে পারবে কী-না তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে। তবে অতীত অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়।
তথ্যসূত্র :
যুগান্তর-১৬ সেপ্টেম্বর/১১, ২. নয়া দিগন্ত-১৭ সেপ্টেম্বর, ৩. সংবাদ-১৭ সেপ্টেম্বর, ৪. মানবজমিন-১৮ সেপ্টেম্বর, ৫. আওয়ামী দুঃশাসন: একটি প্রামাণ্য দলিল. ৬. ইত্তেফাক ৩০ মার্চ/১৯৭৩ সাল, ৭. রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কথা-প্রফেসর ড. এমাজ উদ্দীন আহমদ প্রণীত, ৮. ডিগ্রি রাষ্ট্রবিজ্ঞান-অবিস্মরণীয় প্রকাশনী, ৯. মানবীয় মতবাদ
–
লেখক ও গবেষকঃ মুহম্মদ আলতাফ হোসেন এফএনএস’র সাবেক প্রধান সম্পাদক, কেন্দ্রীয় সভাপতিঃ জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা।
ই-মেইলঃ jss82bangla@gmail.com