শিক্ষা ব্যবস্থার হালফিল পরিস্থিতি দেখিয়া ও শুনিয়া যারপর নাই বেদনা-বিক্ষুব্ধ চিন্তাশীলগণের
অনেকেই। সম্প্রতি তাঁহাদেরই কয়েকজন প্রকাশ করিয়াছেন হতাশাদীর্ণ প্রাণের আকুতি। হাসান আজিজুল
হক; শিক্ষাবিদ এবং দেশবরেণ্য কথাশিল্পী, তিনি বলিয়াছেন, শিক্ষা ব্যবস্থা আজ মুমূর্ষু নয়, মৃত। এখন
শুধু অন্ত্যেষ্টিক্রয়ার অপেক্ষা। তিনি এমন এক সময়ে এই বাণীর বোমা বর্ষণ করিলেন যখন শিক্ষার
প্রসার দেখিয়া কর্তৃপক্ষীয় মহলের আহ্লাদের সীমা নাই। আমাদের অগণিত ছেলেমেয়ে গণ্ডায় গণ্ডায়
সোনার মেডেল না পাইলেও, গোল্ডেন ফাইভ অর্জন করিয়া বাপমায়ের মুখ আলো করিয়া চলিয়াছে
বত্সর বত্সর। আর, উচ্চশিক্ষিত লোকে তো দেশ ভরিয়া গিয়াছে। বেকার ও অর্ধবেকার জনগোষ্ঠীর
এক বৃহদাংশ আজ উচ্চশিক্ষিত। সাম্প্রতিক বত্সরগুলিতে যাহারা শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভাল
রেজাল্ট করিয়াছেন, পড়াশোনা করিয়া বা বিপুল অংকের টাকা খরচ করিয়া যাহারা উচ্চ ডিগ্রি লাভ
করেন, তাহাদের জ্ঞান-গম্যি লইয়া প্রশ্ন তোলা সকলের মুখে শোভা পায় না। কিন্তু, শিক্ষা লইয়া
যাহাদের কারবার, এই বিষয়ে যাহাদের বৈদগ্ধ অনস্বীকার্য, তাহাদেরই কেহ কেহ যখন শিক্ষার মান
লইয়া আক্ষেপ করেন, তখন উহাকে অনর্থক জ্ঞান করা যায় না। গত শুক্রবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সাংবাদিক সমিতির ৪৫ বত্সর পূর্তি উত্সবের দ্বিতীয় দিনে অনুষ্ঠিত সেমিনারে হাসান আজিজুল হক
ছাড়াও বেশ কয়েকজন শিক্ষাবিদ বক্তব্য রাখেন। সকলের কণ্ঠেই ছিল প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা লইয়া
হতাশার সুর। জনাব হক বলেন যে, শিক্ষায় বানরবৃত্তি পরিহার করিয়া মানববৃত্তির জাগরণ ঘটাইতে
হইবে। বানরবৃত্তি বলিতে তিনি কী বুঝাইয়াছেন তাহা অবশ্য পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট পড়িয়া ঠিক
বুঝিতে পারা যায় নাই। সে যাহাই হউক না কেন প্রকৃত ও জীবনমুখি শিক্ষা প্রসঙ্গে তিনি এই
সেমিনারে আরও অনেক তাত্পর্যপূর্ণ কথা বলিয়াছেন, যেইগুলি চিন্তাশীলদের না ভাবাইয়া পারে না।
তিনি জীবন হইতে শিক্ষা লইবার কথা বলিয়াছেন। তিনিসহ সেমিনারের অন্য বক্তাগণ প্রায়োগিক
শিক্ষার উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন। উল্লিখিত সেমিনারে শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে যে
ধারার অভিমত প্রকাশ করা হইয়াছে, তাহা সর্বতোভাবে সমর্থনযোগ্য বলা যায় না। এইরূপ মত
কতকটা একপেশে বলিলেও বোধ করি অত্যুক্তি হয় না। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়া যাহারা
ভাল ফলাফল করিতেছেন এবং যাহারা উচ্চ ডিগ্রি লাভ করিয়াছেন বা করিতেছেন, তাহাদের সকলকে
এক পাল্লায় মাপা কিছুতেই সমীচীন হইতে পারে না। সার্বিক পরিবেশ পরিস্থিতি যাহাই হউক না কেন
, এর মধ্য দিয়া জ্ঞান ও মেধার চর্চা করিয়া চলিয়াছেন অনেকেই। দেশে ও বিদেশের কর্মক্ষেত্রে
তাহারা মেধা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রাখিয়া যাইতেছেন। এতদসত্ত্বেও ইহা অনস্বীকার্য যে, শিক্ষার যেইরূপ
প্রসার ঘটিয়াছে, উচ্চ ডিগ্রিধারীর সংখ্যা যেই হারে বৃদ্ধি পাইয়াছে, সেই তুলনায় গুণগত মান অর্জিত
হয় নাই। পুঁথিগত জ্ঞানকে জীবনের বৃহত্তর পরিসরে কিভাবে প্রয়োগ করিতে হইবে, তাহা অনেকে অর্জন
করিতে পারেন নাই। এই জন্য প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা এককভাবে দায়ী নাকি পারিপার্শ্বিক পরিবেশ
বহুলাংশে দায়ী, তাহা গভীরভাবে চিন্তা করিয়া দেখিবার বিষয়। শিক্ষার মূলগত উদ্দেশ্য কী, তাহা
নির্ণয় করা না হইলে কোথায় আমাদের সমস্যা, তাহাও শনাক্ত করা দুরূহ। শিক্ষার অন্যতম প্রধান
উদ্দেশ্য হইল জীবনবোধ জাগ্রত করা। লেখাপড়ার মধ্য দিয়া মানুষ চিন্তা করিতে শেখে। ইহাকেই বলে
মননশীলতা। মননশীলতার বিকাশ না ঘটিলে মানুষ জীবনসূত্রের সন্ধান পায় না। ঘাটে ঘাটে, পদে
পদে সে ঠেকিয়া যায়। অধিত জ্ঞান ও তথ্যকে জীবনের, কর্মজগতের ছাঁচে ফেলিয়া প্রয়োগসিদ্ধ করিয়া
লইতে পারে না। চীনের মহান দার্শনিক কনফুসিয়াসের একটি বাণী এই খানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি
বলিয়া গিয়াছেন, চিন্তা ছাড়া শিক্ষা সময় নষ্ট বৈ কিছু নয়। কাজেই শিক্ষার্থীদের ভাবনা জাগ্রত করে
এমন শি্ক্ষাই যথার্থ শিক্ষা। কিন্তু সেই শিক্ষা কেবল সরকারের নীতির উপর নির্ভর করে না। সেই
জন্য সেই রকম শিক্ষকও চাই। মেধাবী ও আদর্শনিষ্ঠ শিক্ষকগণই নিশ্চিত করিতে পারেন মানসম্মত
শিক্ষা।
—
শিক্ষাবিদ এবং দেশবরেণ্য কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক