ব্যক্তিগত তথ্য গোপনীয়তা আইন
জাতিসংঘ সনদ
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি কখনোই অন্য এক ব্যক্তির গোপনীয়তা, পারিবারিক বিষয়, বাসস্থান বা যোগাযোগে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এমনকি আত্মসম্মান নষ্ট হয় এমন কোনো পদক্ষেপও নিতে পারবে না। এরকম হস্তক্ষেপ বা আক্রমণের বিরুদ্ধে আইন সুরক্ষিত করতে প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে।
নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদের (International Covenant on Civil and Political Rights) ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদ, জাতিসংঘের কনভেনশন অন মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার’সের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ এবং জাতিসংঘের শিশু সুরক্ষা সনদের ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদে ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে অধিকার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সংবিধান
বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত।
বাংলাদেশের আইন
বাংলাদেশে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অ্যাক্ট’ ২০০৬-এর অধীনে যে সাইবার আইন রয়েছে সেখানে উল্লেখ রয়েছে যে, কোনো ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া ইলেকট্রনিক রেকর্ড, যোগাযোগ সম্পর্কিত তথ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশ করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এছাড়া তথ্য অধিকার আইনে ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা বিষয়ে কয়েকটি অনুচ্ছেদ রয়েছে।
ব্যক্তিগত তথ্য কি
ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা-অধিকারের মধ্যে রয়েছে আয়-ব্যয় সংক্রান্ত তথ্য, অসুস্থতাজনিত তথ্য, যোগাযোগ তথ্য (যেমন– ফোন, মোবাইল নম্বর, পাসপোর্ট, পরিচয়পত্র) ইত্যাদি। স্বাস্থ্যসম্পর্কিত তথ্য যেমন– জিনগত পরীক্ষা এবং এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের তথ্যও গোপনীয়তা অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। যোগাযোগের গোপনীয়তার মধ্যে রয়েছে চিঠি, টেলিফোন, ই-মেইলসহ যোগাযোগের সব ধরনের মাধ্যমের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা রক্ষা। ব্যক্তির গোপনীয়তার ক্ষেত্রে বাসস্থান, কর্মক্ষেত্র বা জনসমাগম স্থান প্রভৃতি জায়গায় অন্যের অবৈধ অনুপ্রবেশকে সীমাবদ্ধ করাও ব্যক্তির গোপনীয়তার অন্তর্ভুক্ত। যেমন তল্লাশি, ভিডিও নজরদারি,পরিচয়পত্র যাচাই ইত্যাদি।
দৈনিক ইত্তেফাক এ প্রকাশিত সংবাদ
২২ অক্টোবর ২০২০
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই অধিকারকে সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট ৯ সদস্যের বিশেষ সাংবিধানিক বেঞ্চ তার রায়ে বলেছে, ভারতের সংবিধানের ২১ নম্বর ধারা অনুযায়ী জীবনের অধিকারের মতোই নিজের ব্যক্তিগত তথ্য গোপন রাখাও একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। বিচারপতি মো. রহুল কুদ্দুসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের হাইকোর্ট বিভাগের একটি বৃহত্তর বেঞ্চ এসংক্রান্ত বিষয়ে সম্প্রতি একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, নাগরিকের গোপনীয়তা রক্ষায় বিটিআরসিসহ দেশের সরকারি-বেসরকারি সব মোবাইল ফোন অপারেটরের দায়িত্ব রয়েছে। সংবিধানেই নাগরিকের এই গোপনীয়তা রক্ষার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। চাইলেই কোনো স্বার্থে নাগরিকের সাংবিধানিক এই অধিকারকে লঙ্ঘন করা যায় না। রায়ে বলা হয়েছে, আমরা ইদানীং লক্ষ করছি যে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল অডিও-ভিডিও কথোপকথন সংগ্রহ করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করছে। ঐ কথোপকথনের অডিও-ভিডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস করার অভ্যাস বন্ধ হওয়া উচিত। আমরা এটা ভুলে যেতে পারি না যে সংবিধানের ৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদে একজন নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। তাই এটা রক্ষা করা ফোন কোম্পানি ও বিটিআরসির দায়িত্ব। তাই এটা বন্ধে বিটিআরসিকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। রায়ে আরো বলা হয়েছে, আনুষ্ঠানিক চাহিদাপত্র ও গ্রাহককে অবহিতকরণ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানি থেকে কললিস্ট বা কল রেকর্ড সংগ্রহ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আইন দ্বারা অনুমোদিত না হলে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোও দেশের নাগরিক বা গ্রাহকের কল লিস্ট সম্পর্কিত কোনো তথ্য কাউকে সরবরাহ করতে পারে না। নইলে সংবিধান কর্তৃক নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হবেন।
দেশের প্রচলিত আইনে একমাত্র তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের সরকারের অনুমতিতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য টেলিফোন কথোপকথন রেকর্ড করার অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৯৭(ক) ধারায় বলা হয়েছে, এই আইন বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে যে কোনো টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহারকারীর প্রেরিত বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, রেকর্ড ধারণ বা তত্সম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য সরকার সময় সময় নির্ধারিত সময়ের জন্য গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোনো কর্মকর্তাকে ক্ষমতা প্রদান করিতে পারিবে এবং উক্ত কার্যক্রমে সার্বিক সহায়তা প্রদানের জন্য টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারীকে নির্দেশ দিতে পারিবে এবং পরিচালনাকারী উক্ত নির্দেশ পালন করিতে বাধ্য থাকিবে? (২) এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ‘সরকার’ বলিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বুঝাইবে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে এই ধারার বিধান প্রয়োগযোগ্য হইবে?’
এ প্রসঙ্গে আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কোনো তদন্তকারী কর্মকর্তা বা গোয়েন্দা সংস্থার কোনো কর্মকর্তা ইচ্ছা করলেই যে কোনো নাগরিকের টেলি কথোপকথন রেকর্ড করতে পারে না। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লিখিত আবেদন লাগবে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর লিখিতভাবে অনুমোদন দিতে হবে এবং যা অনন্তকালের জন্য হবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হতে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেধে দেওয়ার বিষয়টিও আইনে রয়েছে। সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্তদের এ বিষয়ে তাদের ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের বাইরে বিভিন্ন ব্যক্তি পর্যায়ে ফ্রি-স্টাইলে কথোপকথন রেকর্ড চলছে। কিছু কিছু গণমাধ্যম দায়িত্বজ্ঞানহীন ও বেআইনিভাবে এসব কথোপকথন প্রচার করছে। এই বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের প্রতিকারমূলক কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান না থাকায় সংবিধান ও মৌলিক অধিকার রক্ষায় এই বেআইনি কাজ চলছে বলেও অভিমত আইন বিশেষজ্ঞদের।
ঢাকা ল’ রিপোর্টস (ডিএলআর) সম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. খুরশীদ আলম খান ইত্তেফাককে বলেন, ফোনালাপ রেকর্ড ও ফাঁস করে স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল করার বিষয়টি আইনের আওতায় এনে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ এগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির নিরাপত্তা এবং সামাজিক মর্যাদার বিষয় জড়িত। তাই এ বিষয়ে সরকারকে অতিসত্ত্বর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। নইলে নাগরিকের মধ্যে আস্থাহীনতার সংকট দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, ফোনালাপ রেকর্ড ও ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি পৃথক মনিটরিং সেল গঠন করা উচিত।
Source: Ittefaq
‘ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন’ নিয়ে টিআইবির শঙ্কা
ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষায় সরকার নতুন যে আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে, তা ‘বিরুদ্ধ মত নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার ও স্বাধীন মতপ্রকাশের বাধা’ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
টিআইবির সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
প্রস্তাবিত ‘ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন’- এর খসড়ায় ব্যক্তিতথ্য সুরক্ষার চাইতে তথ্য প্রকাশ ও ব্যক্তিতথ্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের প্রয়াসে টিআইবির উদ্বেগ; সকল অংশীজনের মতামত নেওয়ার আহবান
ঢাকা, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১: প্রস্তাবিত ‘ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন’ এর খসড়ায় ব্যক্তিতথ্য সুরক্ষার নামে বিরুদ্ধ মত নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া ও স্বাধীন মতপ্রকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা তৈরি করছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। আইনটি জনসাধারণের তথ্যের সুরক্ষার পরিবর্তে কোনোভাবেই যাতে সরকারের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে জনমত সৃষ্টি এবং ব্যক্তির মতপ্রকাশ ও বাক্স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করার মাধ্যমে একটি ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যবহার না হয়, সেজন্য সরকারকে স্বচ্ছতার সাথে আইন সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনকে একসাথে নিয়ে বৃহৎ পরিসরে আলোচনা ও মতামতের ভিত্তিতে একটি প্রাগ্রসর এবং সময়োপযোগী জনবান্ধব আইন প্রণয়নের উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে টিআইবি।
আজ এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “ব্যাক্তিজীবনে যেভাবে ডিজিটাল স্পেসের গুরুত্ব বাড়ছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে এসব প্ল্যাটফর্মে দেওয়া তথ্যের সুরক্ষায় ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশে^র অনেক দেশেই এ জাতীয় আইন করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনটির মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে, জনগণের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ব্যক্তি যেন ভার্চুয়াল জগতে নিরাপদ বোধ করেন, তার ব্যবস্থা করা। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে, হতাশাজনক হলেও সত্য যে, ইতিপূর্বে প্রণীত ‘নিরাপত্তা’ ও ‘সুরক্ষা’ শব্দযুক্ত আইনগুলো মোটাদাগে নিবর্তনমূলক হিসেবেই প্রমাণিত হয়েছে। পাশাপাশি, বিদ্যমান বিতর্কিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ প্রণনয় পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট অংশীজন যে সকল আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে তার আক্ষরিক প্রতিফলন ঘটেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘নিরাপত্তার’ পরিবর্তে স্বাধীন মতপ্রকাশ ও সরকারের সমালোচনাকারীদের কণ্ঠরোধ করার পাশাপাশি সরকারের অবস্থান সংহত করতে আইনটির যথেচ্ছ ব্যবহার আমরা লক্ষ করছি। সময়ের প্রয়োজনে অন্যান্য দেশের আদলে ‘পারসনাল ডেটা প্রোটেকশন আইন’- এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই সত্যি, কিন্তু শঙ্কার বিষয় হলো আমাদের শাসকগোষ্ঠীর মানসিকতা, প্রবণতা ও উদ্দেশ্য! তাই, প্রস্তাবিত আইনটি যাতে অধিকতর জনবান্ধব, ব্যক্তিতথ্যের সুরক্ষা এবং স্বাধীন মত ও ভাব প্রকাশের সহায়ক হয়, তা নিশ্চিতে বৃহৎ পরিসের সকল পক্ষের অংশগ্রহণে আলোচনা ও মতামতের ভিত্তিতে আইনটি প্রণয়নে সরকারকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে।”
তথ্যসূত্রগুলো বলছে আইনের খসড়াটি ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সির সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হলেও কোনো এক অনির্দিষ্ট কারণে তা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এমন লুকোচুরির কারণ ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন রেখে ড. জামান বলছেন, “এ পদক্ষেপ আইনটি নিয়ে সাধারণের মধ্যে আলোচনা ও মতামতের সুযোগকে বঞ্চিত করার প্রয়াস বলা যায়, যদিও সাধারণের বৃহত্তর কল্যাণে আইনটি প্রণয়ণের কাজে হাত দিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে সকল সংশয় দূর করতে শীঘ্রই খসড়া আইনটি সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশের মাধ্যমে সর্বসাধারণের মতামতের জন্য উন্মুক্ত করতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।”
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রস্তাবিত আইনে জনসাধারণের তথ্যের দেখভাল করার জন্য ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ও একজন সরকারি কর্মকর্তাকে ‘মহাপরিচালক’ হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হবে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলছেন, “বিভিন্ন সময়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির পারিবারিক ও ব্যক্তিগত অডিও এবং ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটলেও বিদ্যমান আইনি কাঠামোতে ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয়নি। এরকম একটি অবস্থায় প্রস্তাবিত আইনে সংশ্লিষ্ট মহাপরিচালকসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘সরল বিশ^াসের’ কর্মকাণ্ডকে নিষ্কলঙ্ক ও বিচার বহির্ভূত রাখার অসাংবিধানিক বিধান কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। পাশাপাশি সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদলতের দ্বারস্ত হয়ে ন্যায়বিচার ও প্রতিকার চাইতে পারবে না মর্মে প্রহসনমূলক ধারার অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়েছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজের আইনের অংশ হতে পারে না।”
তিনি আরো বলেন, “সময়ের প্রয়োজনে আইনটি যদি প্রণয়ন করা হয়, তাহলে সেটা দেখভাল করার দায়িত্ব মহাপরিচালকের অধীনে কোনো এজেন্সির হাতে নয়, বরং একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের মাধ্যমে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির স্বার্থ সুরক্ষাসহ ব্যক্তি গোপনীয়তা ভঙ্গকারী অভিযুক্ত যে কোনো পক্ষকে যাতে আইনের আওতায় আনা যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। একইসাথে, প্রস্তাবিত আইনে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের ‘ডেটা নিয়ন্ত্রণ’ করার উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা’ নির্ধারণ ও মহাপরিচালকের প্রতি তার দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার কথা বলা হচ্ছে। যা, গবেষণা ও অধিপরামর্শমূলক কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের কাজকে ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। ”
‘বাংলাদেশ সরকার ফেসবুক ও ইউটিউবের কাছে যত তথ্য চেয়েছে, তার মাত্র ৪০ শতাংশ দিয়েছে’ একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রীর উদ্বৃত্তি উল্লেখ করে ড. জামান বলছে, “প্রস্তাবিত আইনটির মাধ্যমে কী সরকার সামাজিক যোগযোগমাধ্যমের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়! শত প্রতিকূলতার মাঝেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসমূহের কল্যাণে কিছুটা হলেও জনমত তৈরি ও প্রতিবাদমুখর হতে দেখা যায়। গনমাধ্যমে যেভাবে তথ্য এসেছে, তাতে আইনটির মধ্যে অনেক নিবর্তনমূলক ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে করে স্বাধীন মতপ্রকাশ ও সরকারের সমালোচনাকারীদের নির্বিচারে একহাত নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। ২০১৮ সালে মোবাইল অপারেটরদের কাছ থেকে মিথ্যা বলে বিটিআরসির তথ্য সংগ্রহের উদাহরণ, নতুন আইনের অধীনে তা আরো সহজে করার শঙ্কা পুরো মাত্রায় রয়েছে, যার রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহারের নতুন সুযোগই বাড়াবে। আর ব্যাক্তি তথ্যের সুরক্ষার নামে এমনটা ঘটলে দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্র পিছিয়ে পড়বে, জনকল্যাণ, বাক্স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার চর্চা আরো পিছিয়ে যাবে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্পূর্ণ বিরোধী। তাই প্রস্তাবিত আইনটি প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহ্বান জানাই।”
Source: TIB