২০২০ সালের অক্টোবরে সরকার প্রচলিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করেছে। সংশোধিত আইনে ধর্ষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০২০
জাতিসংঘ সনদে নারীর অধিকার
জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত মৌলিক মানবাধিকারসমূহ (ঘোষণাপত্র, ১৯৪৮)
অনুচ্ছেদ ১৬, অনুচ্ছেদ ২৫
এবং দেখুনঃ
1. UN Women
2. UNICEF সকল শিশুর জন্য
3. OHCHR and women’s human rights
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহ
দেখুনঃ অনুচ্ছেদ ২৮(১), ২৮(২), ২৯(১)
সম্পুর্ন সংবিধান পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নারী ও শিশু নির্যাতনের অন্তর্ভুক্ত অপরাধ সমুহ
বাংলাদেশ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ সংশোধিত ২০১৩ অনুযায়ী যেসব অপরাধ এ আইনের অন্তর্ভুক্ত তা হলো- দহনকারী বা ক্ষয়কারী, নারী পাচার, শিশু পাচার, নারী ও শিশু অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু, নারীর আত্মহত্যায় প্ররোচনা, যৌন নিপীড়ন, যৌতুকের জন্য মৃত্যু ঘটানো, ভিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদির উদ্দেশ্যে শিশুকে অঙ্গহানি, ধর্ষণের ফলে জন্মলাভকারী শিশু সংক্রান্ত বিধান। এ ধরণের যে কোনো ঘটনার শিকার হলে বিচারপ্রার্থীর প্রথম কাজ হলো পার্শ্ববর্তী থানায় বিষয়টি জানানো। কোনো কারণে থানায় পুলিশ যদি মামলা নিতে না চায়, তাহলে সরাসরি সংশ্লিষ্ট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে (বিচারিক হাকিম) আদালতে নালিশি অভিযোগের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের বিচার চেয়ে মামলা দায়ের করতে পারেন।
ধর্ষণের শিকার হলে মামলা করার পূর্বে অবশ্যই করণীয়ঃ
১. ধর্ষণের পর একা থাকবেন না, ঘনিষ্ট জন্দের সাথে রাখুন।
২. র্ষণের চিহ্ন মুঝে যাবার আগেই ডাক্তারের কাছে যান।
৩. হাসপাতালে যাওয়ার পর একজন স্ত্রী বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলুন৷
৪. ধর্ষণকারী যেসব জিনিসের সংস্পর্শে এসেছে তা সব সংগ্রহে রাখুন৷ যেমন পোশাক, অন্তর্বাস, প্যা্ চাদর ইত্যাদি৷
৫. নিজেকে দোষী ভাববেন না, মামলা করতে লজ্জা পাবনেনা; ধর্ষণের মতো জঘণ্যতম কাজটি যে করেছে, সেই শুধু দায়ী, আপনি নন।
৬. নিকটবর্তী থানায় মামলা করুন, থানা মামলা নিতে অনিহা দেখালে আদালতে মামলা করুন ও নিচের দেওয়া লিঙ্কে যোগাযোগ করুন।
থানায় মামলা দায়ের
আপনি উল্লিখিত যে কোনো সহিংসতার শিকার হলে নিকটস্থ থানায় গিয়ে বিষয়টি জানান। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আপনার অভিযোগ এজাহার হিসেবে গণ্য করলে তিনি ঘটনাটি প্রাথমিক তথ্য বিবরণী ফরমে লিপিবদ্ধ করবেন। পরে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট এখতিয়ারসম্পন্ন হাকিম আদালতে প্রেরণ করবেন। এখতিয়ারাধীন হাকিম তা গ্রহণ করলে ওই মামলার আসামিদের আদালতের সামনে উপস্থিত হওয়ার জন্য একটি তারিখ ধার্য করবেন। এবং পরবর্তী সময়ে মামলাটি বিচারের জন্য উপযুক্ত আদালত তথা নারী ও শিশু নির্যাতন অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠাবেন। এরপর নারী ও শিশু নির্যাতন অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল মামলাটি বিচারের জন্য সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য করলে সেই তারিখে মামলাটির বাদী ও অভিযুক্তকে আদালতের সামনে হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিতে হবে এবং মামলার পরবর্তী কার্যক্রম চলতে থাকবে।
থানা মামলা না নিলে আদালতে মামলা
থানায় মামলা না নিলে সরাসরি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যালে আইনজীবীর মাধ্য্যমে মামলা দায়ের করতে পারবেন।কারণ উল্লেখ করে মামলাটি গ্রহণ করা হয়নি মর্মে আবেদনপত্র সঙ্গে নিয়ে সরাসরি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করা যাবে। এক্ষেত্রে একজন আইনজীবীর সহায়তা দিয়ে হলফনামা দিয়ে যথোপযুক্ত প্রমাণাদি ও সাক্ষী দিয়ে ( ধর্ষণজনিত কারণ ও শারীরিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট ও ডকুমেন্টস্, ইত্যাদি যা আছে) মামলাটি দাখিল করতে হবে। বিচারক জবানবন্দি গ্রহণ পূর্বক মামলাটি গ্রহণ করবেন কিংবা জুডিসিয়াল তদন্তের নির্দে শ দিবেন কিংবা তদন্তের নির্দেশ দিবেন যে কোন সংস্থাকে কিংবা থানাকে এজাহার হিসেবে গ্রহণ করারও নির্দেশ দিতে পারেন। এরপর রয়েছে মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ। পুলিশ মামলা নিতে না চাইলে প্রতিকার চাওয়ার আরেকটি মাধ্যম হলো জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
মামলা না নেয়ায় পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে যে শাস্তি হতে পারে
থানায় মামলা না নেয়ায় পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে যে শাস্তি হতে পারে তা পুলিশ আইন ১৮৬১ এর ২৯ নম্বর ধারায় পরিস্কারভাবে উল্লেখ আছে। সেখানে বলা আছে, কোন পুলিশ কর্মচারী যদি কোন নিয়ম বা রেগুলেশন স্বেচ্ছাকৃত ভাবে অমান্য করে বা গাফিলতি এবং পূর্ণভাবে তা পালনে শৈথিল্য করা; তবে তাকে বিচারার্থে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সোপর্দ করা চলবে এবং বিচারে অপরাধী প্রমাণিত হলে ৩ মাসের বেতনের সমপরিমাণ জরিমানা অথবা তিন মাস পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদ- অথবা উভয়বিধ দন্ড হতে পারে। আইনের এই বিধান মামলা গ্রহণ না করার অপরাধকে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে রোধ করার ব্যবস্থা করেছে। এখানে নিয়ম বা রেগুলেশন লংঘন বা গাফিলতি বলতে পিআরবি-এর মামলা গ্রহণ সংক্রান্ত ২৪৪ নিয়মের লংঘনকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ থানায় পুলিশ মামলা গ্রহণ করেননি, এটা প্রমাণিত হলে তার উপরোক্ত শাস্তি হবে।
আপনাকে আইনজীবী দিবে রাষ্ট্র
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলায় বাদী নিজস্ব কোনো আইনজীবী নিয়োগের প্রয়োজন নেই। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯২ ধারা অনুযায়ী তিনি সরকারের পক্ষ থেকে আইনজীবী পাবেন। তিনি মামলার সব তত্ত্বাবধান করবেন। যদি বাদী নিজে আইনজীবী নিয়োগ দিতে চান তাহলে সেই আইনজীবী সরকারি আইনজীবীর অধীনে কাজ করবেন। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োগ দেওয়া আইনজীবীকে কোনো খরচ দিতে হবে না।
বিচার প্রক্রিয়া
দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। এই আইনে ট্রাইব্যুনাল রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার পরিচালনাও করতে পারেন। কোনো ব্যক্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বা স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত মনে করলে বিচারক শুধু মামলার দুই পক্ষকে এবং তাদের নিয়োজিত আইনজীবীদের নিয়ে বিচার পরিচালনা করতে পারেন। তা না করলে বিধান মোতাবেক বিচার পরিচালিত হবে।
মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া
অভিযুক্ত ব্যক্তি হাতেনাতে পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর ১৫ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তদন্ত শেষ করবে। আর অপরাধী ধরা না পড়লে তদন্তের নির্দেশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত সমাপ্ত না হলে তার কারণ ব্যাখ্যা করে সময় শেষ হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ট্রাইব্যুনালকে জানাতে হবে। ট্রাইব্যুনাল ইচ্ছে করলে অন্য কর্মকর্তার ওপর তদন্তভার অর্পণের আদেশ দিতে পারেন। এই আদেশ দেওয়ার সাত দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে।
বিচারের মেয়াদ
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধিত আইন ২০১৩ অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল ১৮০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করবেন। ট্রাইব্যুনাল যদি ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার কারণসংবলিত একটি প্রতিবেদন ৩০ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করবেন। যার একটি অনুলিপি সরকারকেও দিতে হবে। তা ছাড়া এ ক্ষেত্রে পাবলিক প্রসিকিউটর ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ৩০ দিনের মধ্যে সরকারের কাছে কারণ উল্লখপূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করবেন। এ রকম দাখিলকৃত প্রতিবেদনগুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিবেচিত হওয়ার পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার জন্য দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই আইন অনুযায়ী পুলিশ যদি অভিযোগ গ্রহণ না করে সে ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল সরাসরি বিচারের জন্য অভিযোগ নিতে পারেন। এই বিধানটি যদি বাস্তবে প্রয়োগ করা হয়, তবে জনগণের অভিযোগ করা অনেক সহজ হবে।
নিরাপত্তামূলক হেফাজত
এই আইনের অধীন বিচার চলাকালে যদি ট্রাইব্যুনাল মনে করেন কোনো নারী বা শিশুকে নিরাপত্তামূলক হেফাজতে রাখা প্রয়োজন, তাহলে ট্রাইব্যুনাল ওই নারী বা শিশুকে কারাগারের বাইরেও সরকার কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে বা যথাযথ অন্য কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিতে পারেন। বিচার চলাকালে যদি অপরাধী মহল নির্যাতিত নারী বা শিশুকে আবার কোনো ধরনের আঘাত করে বা করতে চায়, তা থেকে রক্ষার জন্য এই বিধান। তা ছাড়া অভিযুক্তকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্যও হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিতে পারে ট্রাইব্যুনাল। তবে কোনো নারী বা শিশুকে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখার আদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল ওই নারী বা শিশুর মতামত গ্রহণ ও বিবেচনা করবেন।
আগাম জামিনের পথ বন্ধ আসামীর জন্য
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটি একটি বিশেষ আইন। এ মামলায় হাইকোর্টকে আগাম জামিন দেওয়ার এখতিয়ার দেওয়া হয়নি। বিশেষ আইনে জামিনের ক্ষেত্রে সাধারণত ফৌজদারি কার্যবিধির বিধানগুলো প্রযোজ্য হবে না। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১৯(২)(৩) ও (৪) উপধারায় জামিনের বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির কোনো বিধান ১৯ ধারায় প্রযোজ্য হয়নি। যদিও সামাজিক বাস্তবতার বিষয় চিন্তা করে কয়েক বছর ধরে হাইকোর্ট এ ধরনের মামলায় আগাম জামিন দিচ্ছেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন অপরাধের শাস্তি
বাংলাদেশ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ সংশোধিত ২০১৩ অনুযায়ী এসব অপরাধ প্রমাণিত হলে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। এ ছাড়াও রয়েছে অর্থদণ্ডের বিধান।
আপনাকে যারা সহযোগিতা করবে
আপনি যদি মামলা করতে অসমর্থ হন বা কোনো হুমকির সম্মুখীন হন, তাহলে কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন রয়েছে যারা আপনাকে সহযোগিতা করবে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড (ব্লাস্ট), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল প্রভৃতি।
প্রয়োজনীয় লিঙ্কঃ
নারী ও শিশু নির্যাতন নিরোধ কমিটি
নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কার্যক্রম
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশ
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড (ব্লাস্ট)